Tuesday, March 19, 2013

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


বাঁশি


কিনু গোয়ালার গলি।
                দোতলা বাড়ির
       লোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর
                  পথের ধারেই।


     লোনাধরা দেয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি,
           মাঝে মাঝে স্যাঁতাপড়া দাগ।
     মার্কিন থানের মার্কা একখানা ছবি
               সিদ্ধিদাতা গণেশের
                         দরজার 'পরে আঁটা।
           আমি ছাড়া ঘরে থাকে আর একটি জীব
                      এক ভাড়াতেই,
                             সেটা টিকটিকি।
                     তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু,
                          নেই তার অন্নের অভাব॥


         বেতন পঁচিশ টাকা,
               সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি।
খেতে পাই দত্তদের বাড়ি
        ছেলেকে পড়িয়ে।
শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,
    সন্ধ্যেটা কাটিয়ে আসি,
       আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।
           এঞ্জিনের ধস্ ধস্,
               বাঁশির আওয়াজ,
                   যাত্রীর ব্যস্ততা,
                      কুলি-হাঁকাহাঁকি।
                         সাড়ে-দশ বেজে যায়,
         তার পরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার॥

  ধলেশ্বরী-নদীতীরে পিসিদের গ্রাম---
               তাঁর দেওরের মেয়ে,
  অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।
         লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল---
              সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।
                    মেয়েটা তো রক্ষে পেলে,
                          আমি তথৈবচ।
  ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া---
            পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর॥

                          বর্ষা ঘনঘোর।
                    ট্রামের খরচা বাড়ে,
              মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়।
                    গলিটার কোণে কোণে
              জমে ওঠে, পচে ওঠে
          আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি,
                 মাছের কান্‌কা,
                        মরা বেড়ালের ছানা---
               ছাইপাঁশ আরো কত কী যে।
            ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়া
                   মাইনের মতো,
                           বহু ছিদ্র তার।
                        আপিসের সাজ
               গোপীকান্ত গোঁসাইয়ের মনটা যেমন,
                    সর্বদাই রসসিক্ত থাকে।
                        বাদলের কালো ছায়া
                    স্যাঁত্‍‌সেঁতে ঘরটাতে ঢুকে
                        কলে পড়া জন্তুর মতন
                             মূর্ছায় অসাড়!
                    দিনরাত, মনে হয়, কোন্ আধমরা
               জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি।

               গলির মোড়েই থাকে কান্তবাবু---
                    যত্নে-পাট-করা লম্বা চুল,
                         বড়ো বড়ো চোখ,
                               শৌখিন মেজাজ।
                         কর্নেট বাজানো তার শখ।
                মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠে
                            এ গলির বীভত্‍‌স বাতাসে---
                কখনো গভীর রাতে,
                         ভোরবেলা আলো-অন্ধকারে,
                কখনো বৈকালে
                         ঝিকিমিকি আলো-ছায়ায়।
                               হঠাত্‍‌ সন্ধ্যায়
        সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান,
           সমস্ত আকাশে বাজে
               অনাদি কালের বিরহবেদনা।
           তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে
               এ গলিটা ঘোর মিছে
        দুর্বিষহ মাতালের প্রলাপের মতো।
           হঠাত্‍‌ খবর পাই মনে,
    আকবর বাদশার সঙ্গে
           হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।
                বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে
                     ছেঁড়া ছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে
                          এক বৈকুণ্ঠের দিকে॥

         এ গান যেখানে সত্য
              অনন্ত গোধুলিলগ্নে
                    সেইখানে
                        বহি চলে ধলেশ্বরী,
              তীরে তমালের ঘন ছায়া---
                    আঙিনাতে
              যে আছে অপেক্ষা ক'রে, তার
       পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর॥


২৫ আষাঢ় ১৩৩৯
সূত্রঃ পরিশেষ




অনন্ত প্রেম


তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার–
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্র“বতারকার বেশে।

আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।

আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি–
সকল কালের সকল কবির গীতি।
কবিতার বিষয়: প্রেমের কবিতা


নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ


                    আজি এ প্রভাতে রবির কর
                    কেমনে পশিল প্রাণের পর,
       কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!
    না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
                        জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
                     ওরে উথলি উঠেছে বারি,
   ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।
                    থর থর করি কাঁপিছে ভূধর,
                   শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,
                   ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
                    গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।
                   হেথায় হোথায় পাগলের প্রায়
                   ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায় -
    বাহিরেতে চায়, দেখিতে না পায় কোথায় কারার দ্বার।
                   কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন,
                    চারি দিকে তার বাঁধন কেন!
                   ভাঙ্ রে হৃদয়, ভাঙ্ রে বাঁধন,
                  সাধ্ রে আজিকে প্রাণের সাধন,
                     লহরীর পরে লহরী তুলিয়া
                    আঘাতের পরে আঘাত কর্।
                    মাতিয়া যখন উঠেছে পরান
                  কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ!
                     উথলি যখন উঠেছে বাসনা
                     জগতে তখন কিসের ডর!

                     আমি ঢালিব করুণাধারা,
                     আমি ভাঙিব পাষাণকারা,
                আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
                        আকুল পাগল-পারা।
                  কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,
                  রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,
       রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া দিব রে পরান ঢালি।
                    শিখর হইতে শিখরে ছুটিব,
                     ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব,
    হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি।
এত কথা আছে, এত গান আছে, এত প্রাণ আছে মোর,
এত সুখ আছে, এত সাধ আছে - প্রাণ হয়ে আছে ভোর।।

      কী জানি কী হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ -
           দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।
                    ওরে, চারি দিকে মোর
                     এ কী কারাগার ঘোর -
      ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাত কর্।
            ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি,
                      এসেছে রবির কর।।
কবিতার বিষয়: জীবনমুখী কবিতা


বিসর্জন


দুইটি কোলের ছেলে গেছে পর পর
বয়স না হতে হতে পুরা দু বছর।
এবার ছেলেটি তার জন্মিল যখন
স্বামীরেও হারালো মল্লিকা। বন্ধুজন
বুঝাইল--- পূর্বজন্মে ছিল বহু পাপ,
এ জনমে তাই হেন দারুণ সন্তাপ।
শোকানলদগ্ধ নারী একান্ত বিনয়ে
অজ্ঞাত জন্মের পাপ শিরে বহি লয়ে
প্রায়শ্চিত্তে দিল মন। মন্দিরে মন্দিরে
যেথা সেথা গ্রামে গ্রামে পূজা দিয়া ফিরে।
ব্রতধ্যান-উপবাসে আহ্নিকে তর্পণে
কাটে দিন ধূপে দীপে নৈবেদ্যে চন্দনে,
পূজাগৃহে; কেশে বাঁধি রাখিল মাদুলি
কুড়াইয়া শত ব্রাহ্মণের পদধূলি;
শুনে রামায়ণকথা; সন্ন্যাসী-সাধুরে
ঘরে আনি আশীর্বাদ করায় শিশুরে।
বিশ্বমাঝে আপনারে রাখি সর্ব-নীচে
সবার প্রসন্ন দৃষ্টি অভাগী মাগিছে
আপন সন্তান-লাগি; সূর্য চন্দ্র হতে
পশুপক্ষী পতঙ্গ অবধি--- কোনোমতে
কেহ পাছে কোনো অপরাধ লয় মনে,
পাছে কেহ করে ক্ষোভ, অজানা কারণে
পাছে কারো লাগে ব্যথা, সকলের কাছে
আকুল বেদনা-ভরে দীন হয়ে আছে।

যখন বছর-দেড় বয়স শিশুর---
যকৃতের ঘটিল বিকার; জ্বরাতুর
দেহখানি শীর্ণ হয়ে আসে। দেবালয়ে
মানিল মানত মাতা, পদামৃত লয়ে
করাইল পান, হরিসংকীর্তন-গানে
কাঁপিল প্রাঙ্গণ। ব্যাধি শান্তি নাহি মানে।
কাঁদিয়া শুধালো নারী, ``ব্রাহ্মণঠাকুর,
এত দুঃখে তবু পাপ নাহি হল দূর!
দিনরাত্রি দেবতার মেনেছি দোহাই,
দিয়েছি এত যে পূজা তবু রক্ষা নাই!
তবু কি নেবেন তাঁরা আমার বাছারে!
এত ক্ষুধা দেবতার! এত ভারে ভারে
নৈবেদ্য দিলাম খেতে বেচিয়া গহনা,
সর্বস্ব খাওয়ানু তবু ক্ষুধা মিটিল না!'
ব্রাহ্মণ কহিল, "বাছা, এ যে ঘোর কলি।
অনেক করেছ বটে তবু এও বলি---
আজকাল তেমন কি ভক্তি আছে কারো?
সত্যযুগে যা পারিত তা কি আজ পারো?
দানবীর কর্ণ-কাছে ধর্ম যবে এসে
পুত্রেরে চাহিল খেতে ব্রাহ্মণের বেশে,
নিজ হস্তে সন্তানে কাটিল; তখনি সে
শিশুরে ফিরিয়া পেল চক্ষের নিমেষে।
শিবিরাজা শ্যেনরূপী ইন্দ্রের মুখেতে
আপন বুকের মাংস কাটি দিল খেতে---
পাইল অক্ষয় দেহ। নিষ্ঠা এরে বলে।
তেমন কি এ কালেতে আছে ভূমণ্ডলে?
মনে আছে ছেলেবেলা গল্প শুনিয়াছি
মার কাছে--- তাঁদের গ্রামের কাছাকাছি
ছিল এক বন্ধ্যা নারী, না পাইয়া পথ
প্রথম গর্ভের ছেলে করিল মানত
মা-গঙ্গার কাছে। শেষে পুত্রজন্ম-পরে,
অভাগী বিধবা হল; গেল সে সাগরে,
কহিল সে নিষ্ঠাভরে মা-গঙ্গারে ডেকে,
'মা, তোমারি কোলে আমি দিলাম ছেলেকে---
এ মোর প্রথম পুত্র, শেষ পুত্র এই,
এ জন্মের তরে আর পুত্র-আশা নেই।'
যেমনি জলেতে ফেলা, মাতা ভাগীরথী
মকরবাহিনী-রূপে হয়ে মূর্তিমতী
শিশু লয়ে আপনার পদ্মকরতলে
মার কোলে সমর্পিল।--- নিষ্ঠা এরে বলে।"

মল্লিকা ফিরিয়া এল নতশির ক'রে,
আপনারে ধিক্কারিল--- "এত দিন ধরে
বৃথা ব্রত করিলাম, বৃথা দেবার্চনা---
নিষ্ঠাহীনা পাপিষ্ঠারে ফল মিলিল না।"

ঘরে ফিরে এসে দেখে শিশু অচেতন
জ্বরাবেশে; অঙ্গ যেন অগ্নির মতন।
ঔষধ গিলাতে যায় যত বার বার
পড়ে যায়--- কণ্ঠ দিয়া নামিল না আর।
দন্তে দন্তে গেল আঁটি। বৈদ্য শির নাড়ি
ধীরে ধীরে চলি গেল রোগীগৃহ ছাড়ি।
সন্ধ্যার আঁধারে শূন্য বিধবার ঘরে
একটি মলিন দীপ শয়নশিয়রে,
একা শোকাতুরা নারী। শিশু একবার
জ্যোতিহীন আঁখি মেলি যেন চারি ধার
খুঁজিল কাহারে। নারী কাঁদিল কাতর---
"ও মানিক, ওরে সোনা, এই-যে মা তোর,
এই-যে মায়ের কোল, ভয় কী রে বাপ।"
বক্ষে তারে চাপি ধরি তার জ্বরতাপ
চাহিল কাড়িয়া নিতে অঙ্গে আপনার
প্রাণপণে। সহসা বাতাসে গৃহদ্বার
খুলে গেল; ক্ষীণ দীপ নিবিল তখনি;
সহসা বাহির হতে কলকলধ্বনি
পশিল গৃহের মাঝে। চমকিল নারী,
দাঁড়ায়ে উঠিল বেগে শয্য়াতল ছাড়ি;
কহিল, "মায়ের ডাক ঐ শোনা যায়---
ও মোর দুখীর ধন, পেয়েছি উপায়---
তোর মার কোল চেয়ে সুশীতল কোল
আছে ওরে বাছা।"

                   জাগিয়াছে কলরোল
অদূরে জাহ্নবীজলে, এসেছে জোয়ার
পূর্ণিমায়। শিশুর তাপিত দেহভার
বক্ষে লয়ে মাতা, গেল শূন্য ঘাট-পানে।
কহিল, "মা, মার ব্যথা যদি বাজে প্রাণে
তবে এ শিশুর তাপ দে গো মা, জুড়ায়ে।
একমাত্র ধন মোর দিনু তোর পায়ে
একমনে।" এত বলি সমর্পিল জলে
অচেতন শিশুটিরে লয়ে করতলে
চক্ষু মুদি। বহুক্ষণ আঁখি মেলিল না।
ধ্যানে নিরখিল বসি, মকরবাহনা
জ্যোতির্ময়ী মাতৃমূর্তি ক্ষুদ্র শিশুটিরে
কোলে করে এসেছেন, রাখি তার শিরে
একটি পদ্মের দল। হাসিমুখে ছেলে
অনিন্দিত কান্তি ধরি দেবী-কোল ফেলে
মার কোলে আসিবারে বাড়ায়েছে কর।
কহে দেবী, "রে দুঃখিনী, এই তুই ধর্,
তোর ধন তোরে দিনু।" রোমাঞ্চিতকায়
নয়ন মেলিয়া কহে, "কই মা... কোথায়!"
পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকে বিহ্বলা রজনী;
গঙ্গা বহি চলি যায় করি কলধ্বনি।
চীত্‍‌কারি উঠিল নারী, "দিবি নে ফিরায়ে!"
মর্মরিল বনভূমি দক্ষিণের বায়ে।
কবিতার বিষয়: বিরহের কবিতা



বীরপুরুষ


মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে
     মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে ।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ’পরে
     টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে ।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
     রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে ।

     সন্ধে হল,সূর্য নামে পাটে
     এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে ।
ধূ ধূ করে যে দিক পানে চাই
কোনোখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপনমনে তাই
     ভয় পেয়েছ; ভাবছ, এলেম কোথা?
আমি বলছি, ‘ভয় পেয়ো না মা গো,
     ঐ দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা ।’

চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে,
    মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে ।
গোরু বাছুর নেইকো কোনোখানে,
সন্ধে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে,
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে,
     অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো ।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
      ‘দিঘির ধারে ঐ যে কিসের আলো!’

     এমন সময় 'হারে রে রে রে রে’
     ঐ যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে ।
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে
     পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো।
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে,
     ‘আমি আছি, ভয় কেন মা কর।’

হাতে লাঠি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল
     কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল ।
আমি বলি, ‘দাঁড়া, খবরদার!
এক পা আগে আসিস যদি আর -
এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার,
     টুকরো করে দেব তোদের সেরে ।’
শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে
     চেঁচিয়ে উঠল, ‘হারে রে রে রে রে।’

     তুমি বললে, ‘যাস না খোকা ওরে’
     আমি বলি, ‘দেখো না চুপ করে।’
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে,
ঢাল তলোয়ার ঝন্‌ঝনিয়ে বাজে
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে,
     শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,
     কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।

এত লোকের সঙ্গে লড়াই করে
     ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে’,
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
     চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে -
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল!
     কী দুর্দশাই হত তা না হলে।’

     রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা -
     এমন কেন সত্যি হয় না আহা।
ঠিক যেন এক গল্প হত তবে,
শুনত যারা অবাক হত সবে,
দাদা বলত, ‘কেমন করে হবে,
     খোকার গায়ে এত কি জোর আছে।’
পাড়ার লোকে বলত সবাই শুনে,
      ‘ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে।’
কবিতার বিষয়: ছোটদের ছড়া-কবিতা
_________________________________________________________


অন্তর মম বিকশিত করো

অন্তর মম বিকশিত করো
     অন্তরতর হে।
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো,
    সুন্দর কর হে।
           জাগ্রত করো, উদ্যত করো,
                নির্ভয় করো হে।
      মঙ্গল করো, নরলস নিঃসংশয় করো হে।
           অন্তর মম বিকশিত করো,
                অন্তরতর হে।

যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,
  মুক্ত করো হে বন্ধ,
সঞ্চার করো সকল মর্মে
  শান্ত তোমার ছন্দ।
      চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে,
          নন্দিত করো, নন্দিত করো,
              নন্দিত করো হে।
          অন্তর মম বিকশিত করো
               অন্তরতর হে।



শিলাইদহ
২৭ অগ্রাহায়ণ ১৩১৪
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ৫
কবিতার বিষয়: জীবনমুখী কবিতা, ধর্মীয় কবিতা

No comments:

Post a Comment