Wednesday, March 20, 2013

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত


ঝর্ণা


ঝর্ণা! ঝর্ণা! সুন্দরী ঝর্ণা!
তরলিত চন্দ্রিকা! চন্দন-বর্ণা!
     অঞ্চল সিঞ্চিত গৈরিকে স্বর্ণে,
     গিরি-মল্লিকা দোলে কুন্তলে কর্ণে,
তনু ভরি' যৌবন, তাপসী অপর্ণা! 

            ঝর্ণা!
পাষাণের স্নেহধারা! তুষারের বিন্দু!
ডাকে তোরে চিত-লোল উতরোল সিন্ধু|
     মেঘ হানে জুঁইফুলী বৃষ্টি ও-অঙ্গে,
     চুমা-চুমকীর হারে চাঁদ ঘেরে রঙ্গে,
ধূলা-ভরা দ্যায় ধরা তোর লাগি ধর্ণা!
             ঝর্ণা!
এস তৃষার দেশে এস কলহাস্যে -
গিরি-দরী-বিহীরিনী হরিনীর লাস্যে,
     ধূসরের ঊষরের কর তুমি অন্ত,
     শ্যামলিয়া ও পরশে কর গো শ্রীমন্ত;
ভরা ঘট এস নিয়ে ভরসায় ভর্ণা;
             ঝর্ণা!
শৈলের পৈঠৈয় এস তনুগত্রী!
পাহাড়ে বুক-চেরা এস প্রেমদাত্রী!
     পান্নার অঞ্জলি দিতে দিতে আয় গো,
     হরিচরণ-চ্যুতা গঙ্গার প্রায় গো,
স্বর্গের সুধা আনো মর্ত্যে সুপর্ণা!
             ঝর্ণা!
মঞ্জুল ও-হাসির বেলোয়ারি আওয়াজে
ওলো চঞ্চলা ! তোর পথ হল ছাওয়া যে!
     মোতিয়া মোতির কুঁড়ি মূরছে ও-অলকে;
     মেখলায়, মরি মরি, রামধনু ঝলকে
তুমি স্বপ্নের সখী বিদ্যুত্পর্ণা
             ঝর্ণা!
কবিতার বিষয়: প্রকৃতির কবিতা
________________________________________________________


ইলশে গুঁড়ি

ইলশে গুঁড়ি!          ইলশে গুঁড়ি
              ইলিশ মাছের ডিম|
       ইলশে গুঁড়ি          ইলশে গুঁড়ি
              দিনের বেলায় হিম|
           কেয়াফুলে ঘুণ লেগেছে,
        পড়তে পরাগ মিলিয়ে গেছে,
       মেঘের সীমায় রোদ হেসেছে
             আলতা-পাটি শিম্|
     ইলশে গুঁড়ি          হিমের কুঁড়ি,
             রোদ্দুরে রিম্ ঝিম্|
হালকা হাওয়ায়          মেঘের ছাওয়ায়
             ইলশে গুঁড়ির নাচ, -
    ইলশে গুঁড়ির          নাচন্ দেখে
            নাচছে ইলিশ মাছ|
     কেউ বা নাচে জলের তলায়
  ল্যাজ তুলে কেউ ডিগবাজি খায়,
    নদীতে ভাই জাল নিয়ে আয়,
           পুকুরে ছিপ গাছ|
     উলসে ওঠে মনটা, দেখে
           ইলশে গুঁড়ির নাচ|

  ইলশে গুঁড়ি          পরীর ঘুড়ি
           কোথায় চলেছে,
ঝমরো চুলে          ইলশে গুঁড়ি
           মুক্তো ফলেছে!
      ধানেক বনে চিংড়িগুলো
    লাফিয়ে ওঠে বাড়িয়ে নুলো;
    ব্যাঙ ডাকে ওই গলা ফুলো,
           আকাশ গলেছে,
বাঁশের পাতায়          ঝিমোয় ঝিঁঝিঁ,
            বাদল চলেছে|

মেঘায় মেঘায়          সূর্য্যি ডোবে
          জড়িয়ে মেঘের জাল,
ঢাকলো মেঘের          খুঞ্চে-পোষে
          তাল-পাটালীর থাল|
       লিখছে যারা তালপাতাতে
      খাগের কলম বাগিয়ে হাতে
     তাল বড়া দাও তাদের পাতে
           টাটকা ভাজা চাল;
পাতার বাঁশী          তৈরী করে'
          দিও তাদের কাল|

  খেজু পাতায়          সবুজ টিয়ে
           গড়তে পারে কে?
তালের পাতার          কানাই ভেঁপু
           না হয় তাদের দে|
     ইলশে গুঁড়ি - জলের ফাঁকি
      ঝরছে কত বলব তা কী?
      ভিজতে এল বাবুই পাখী
          বাইরে ঘর থেকে; -
পড়তে পাখায়          লুকালো জল
        ভিজলো নাকো সে|

  ইলশে গুঁড়ি!          ইলশে গুঁড়ি!
          পরীর কানের দুল,
  ইলশে গুঁড়ি!          ইলশে গুঁড়ি!
          ঝরো কদম ফুল|
      ইলশে গুঁড়ির খুনসুড়িতে
     ঝাড়ছে পাখা - টুনটুনিতে
    নেবুফুলের          কুঞ্জটিতে
         দুলছে দোদুল দুল্;
ইলশে গুঁড়ি           মেঘের খেয়াল
         ঘুম-বাগানের ফুল|
কবিতার বিষয়: প্রকৃতির কবিতা
_________________________________________________________


ছিন্নমুকুল

সবচেয়ে যে ছোট পিড়ি খানি
সেখানি আর কেউ রাখেনা পেতে,
ছোটথালায় হয় নাকো ভাতবাড়া
জল ভরে না ছোট্ট গেলাসেতে।
বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট
খাবার বেলা কেউ ডাকে না তাকে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল,
তারই খাওয়া ঘুচেছে সব আগে।

সবচেয়ে যে অল্পে ছিল খুশি,
খুশি ছিল ঘেষাঘেষির ঘরে,
সেই গেছে হায়, হাওয়ার সঙ্গে মিশে,
দিয়ে গেছে জায়গা খালি করে।
ছেড়ে গেছে পুতুল, পুঁতির মালা,
ছেড়ে গেছে মায়ের কোলের দাবি।
ভয়ভরা সে ছিল যে সব চেয়ে
সেই খুলেছে আঁধার ঘরের চাবি।

হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে ওরে!
হারিয়ে গেছে 'বোল' বলা সেই বাঁশি
দুধে ধোওয়া কচি সে মুখখানি
আঁচল খুলে হঠাৎ স্রোতের জলে
ভেসে গেছে শিউলী ফুলের রাশি,
ঢুকেছে হায় শশ্মান ঘরের মাঝে
ঘর ছেড়ে হায় হৃদয় শশ্মানবাসী।

সবচেয়ে যে ছোট কাপড়গুলি
সেইগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে,
যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোট,
আজকে সেটি শূন্য পড়ে কাঁদে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল
সেই গিয়েছে সবার আগে সরে।
ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে,
সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে।
কবিতার বিষয়: বিরহের কবিতা
_________________________________________________________


পদ্মার প্রতি

হে পদ্মা! প্রলয়ংকরী! হে ভীষণা! ভৈরবী সুন্দরী!
হে প্রগলভা! হে প্রবলা! সমুদ্রের যোগ্য সহচরী
তুমি শুধু, নিবিড় আগ্রহ আর পার গো সহিতে
একা তুমি সাগরের প্রিয়তমা, অয়ি দুবিনীতে!

দিগন্ত বিস্তৃত তোমার হাস্যের কল্লোল তারি মত
চলিয়াছে তরঙ্গিয়া, - চির দৃপ্ত, চির অব্যাহত|
দুর্নমিত, অসংযত, গূঢ়চারী, গহন গম্ভীর;
সীমাহীন অবজ্ঞায় ভাঙিয়া চলেছ উভতীর |

রুদ্র সমুদ্রের মত, সমুদ্রেরি মত সমুদার
তোমার বদরহস্ত বিতরিছে ঐশ্বর্যসম্ভার|
উর্বর করিছ মহি, বহিতেছ বাণিজ্যের তরী
গ্রাসিয়া নগর গ্রাম হাসিতেছ দশদিক ভরি|

অন্তহীন মূর্ছনায় আন্দোলিত আকাশ সংগীতে, -
ঝঙ্কারিয়া রুদ্রবীণা, মিলাইছ ভৈরবে ললিতে
প্রসন্ন কখনো তুমি, কভু তুমি একান্ত নিষ্ঠুর;
দুর্বোধ, দুর্গম হায়, চিরদিন দুর্জ্ঞেয় সুদূর!

শিশুকাল হতে তুমি উচ্ছৃঙ্খল, দুরন্ত দুর্বার;
সগর রাজার ভস্ম করিয়ে স্পর্শ একবার!
স্বর্গ হতে অবতরি ধেয়ে চলে এলে এলোকেশে,
কিরাত-পুলিন্দ-পুণ্ড্র অনাচারী অন্ত্যজের দেশে!

বিস্ময়ে বিহ্বল-চিত্ত ভগীরথ ভগ্ন মনোরথ
বৃথা বাজাইল শঙ্খ, নিলে বেছে তুমি নিজ পথ;
আর্যের নৈবেদ্য, বলি, তুচ্ছ করি হে বিদ্রোহী নদী!
অনাহুত-অনার্যের ঘরে গিয়ে আছ সে অবধি|

সেই হকে আছ তুমি সমস্যার মত লোক-মাঝে,
ব্যাপৃত সহস্র ভুজ বিপর্যয় প্রলয়ের কাজে!
দম্ভ যবে মূর্তি ধরি স্তম্ভ ও গম্ বুজে দিনরাত
অভ্রভেদী হয়ে ওঠে, তুমি না দেখাও পক্ষপাত|

তার প্রতি কোনদিন, সিন্ধুসঙ্গী, হে সাম্যবাদিনী!
মূর্খে বলে কীতিনাশা, হে কোপনা কল্লোলনাদিনী! 
ধনী দীনে একাসনে বসায়ে রেখেছ তব তীরে,
সতত সতর্ক তারা অনিশ্চিত পাতার কুটিরে;

না জানে সুপ্তির স্বাদ, জড়তার বারতা না জানে,
ভাঙ্গনের মুখে বসি গাহে গান প্লাবনের তানে,
নাহিক বস্তুর মায়া, মরিতে প্রস্তুত চির দিনই!
অয়ি স্বাতন্ত্রের ধারা! অয়ি পদ্মা! অয়ি বিপ্লাবনী!
কবিতার বিষয়: প্রকৃতির কবিতা
_________________________________________________________

No comments:

Post a Comment