Tuesday, March 19, 2013

কাজী নজরুল

বিদ্রোহী


বল বীর -
          বল উন্নত মম শির!
শির     নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
               বল বীর -
বল     মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'
          চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি'
          ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
          খোদার আসন "আরশ" ছেদিয়া


               উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!
মম     ললাটে রুদ্র-ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
               বল বীর -
          আমি চির-উন্নত শির!

আমি     চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা-     প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি     মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!
               আমি দুর্ব্বার,
আমি     ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি     অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি     দ'লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল!
আমি     মানি নাকো কোনো আইন,
আমি     ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম,
                              ভাসমান মাইন!
আমি     ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি     বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
               বল বীর -
           চির উন্নত মম শির!

আমি     ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণী,
আমি     পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণী!
আমি     নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি     আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি     হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি     চল-চঞ্চল, ঠুমকি' ছমকি'
           পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি'
           ফিং দিয়া দিই তিন দোল্!
আমি     চপলা-চপল হিন্দোল!

আমি     তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা',
করি      শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
           আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি     মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর।
আমি     শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর।
               বল বীর -
          আমি     চির-উন্নত শির!

          আমি     চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ,
আমি     দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম্
                              ভরপুর মদ।
আমি     হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি,
আমি     যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি!
আমি     সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি     অবসান, নিশাবসান।
আমি     ইন্দ্রাণি-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য,
মম     এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য।
আমি     কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।
আমি     ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
               বল বীর -
          চির উন্নত মম শির।

আমি     সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক
আমি     যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক!
আমি     বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি     আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি     বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি     ইস্ত্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি     পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দন্ড,
আমি     চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ-প্রচন্ড!
আমি     ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি     দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব!
আমি     প্রাণ-খোলা-হাসি উল্লাস, - আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি     মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি     কভু প্রশান্ত, - কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি     অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্প-হারী!
আমি     প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি     উজ্জ্বল আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি     উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল!

আমি     বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি     ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি।
আমি     উন্মন মন উদাসীর,
আমি     বিধাতার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর!
আমি     বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের,
আমি     অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত
                              বুকে গতি ফের!
আমি     অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত-     চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি     গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক'রে দেখা অনুখন,
আমি     চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা'র কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্।
আমি     চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি     যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর!
আমি     উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাসী পূরবী হাওয়া,
আমি     পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীনে গান গাওয়া!
আমি     আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র রবি,
আমি     মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! -
আমি     তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি     সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে
                              সব বাঁধ!

আমি     উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি     বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন!
ছুটি     ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
          স্বর্গ-মর্ত্ত্য করতলে,
          তাজি বোরবাক্ আর উচ্চৈস্রবা বাহন আমার
                              হিম্মত-হ্রেস্বা হেঁকে চলে!
আমি     বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল,
আমি     পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথর-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি     তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ,
আণি     ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা, সঞ্চরি' ভূমি-কম্প!
          ধরি বাসুকির ফনা জাপটি', -
ধরি     স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি'!
          আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি     ধৃষ্ট আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!

               আমি     অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
               মহা-     সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্
          ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্
          মম বাঁশরী তানে পাশরি'
          আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি     রুষে উঠে' যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে     সপ্ত নরক হারিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি     বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!

আমি     প্লাবন-বন্যা,
কভু     ধরণীরে করি বরণিয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা -
আমি     ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি     অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি     ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি!
আমি     ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি     জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!

আমি     মৃণ্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি     অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি     মানব দানব দেবতার ভয়,
          বিশ্বের আমি চির দুর্জ্জয়,
          জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি     তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্ত্য
আমি     উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি     চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে
                              সব বাঁধ!!
আমি     পরশুরামের কঠোর কুঠার,
          নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি     হল বলরাম স্কন্ধে,
আমি     উপাড়ি' ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।

          মহা-     বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
          আমি     সেই দিন হব শান্ত,
যবে     উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
          অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
               বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
          আমি     আমি সেই দিন হব শান্ত!
আমি     বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি     স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন!
আমি     বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
          আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!

          আমি চির-বিদ্রোহী বীর -
আমি     বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!

কবিতার বিষয়: মানবতাবাদী কবিতা, যুদ্ধের কবিতা
__________________________________________________________________________________

অ-নামিকা


তোমারে বন্দনা করি
স্বপ্ন-সহচরী
লো আমার অনাগত প্রিয়া,
আমার পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া!
তোমারে বন্দনা করি….
হে আমার মানস-রঙ্গিণী,
অনন্ত-যৌবনা বালা, চিরন্তন বাসনা-সঙ্গিনী!
তোমারে বন্দনা করি….
নাম-নাহি-জানা ওগো আজো-নাহি-আসা!
আমার বন্দনা লহ, লহ ভালবাসা….
গোপণ-চারিণী মোর, লো চির-প্রেয়সী!
সৃষ্টি-দিন হ’তে কাঁদ’ বাসনার অন্তরালে বসি’-
ধরা নাহি দিলে দেহে।
তোমার কল্যাণ-দীপ জ্বলিলে না
দীপ-নেভা বেড়া-দেওয়া গেহে।
অসীমা! এলে না তুমি সীমারেখা-পারে!
স্বপনে পাইয়া তোমা’ স্বপনে হারাই বারে বারে
অরুপা লো! রহি হ’য়ে এলে মনে,
সতী হ’য়ে এলে না ক’ ঘরে।
প্রিয় হ’য়ে এলে প্রেমে,
বধূ হয়ে এলে না অধরে!
দ্রাক্ষা-বুকে রহিলে গোপনে তুমি শিরীন্‌ শরাব,
পেয়ালায় নাহি এলে!-
‘উতারো নেকার’-
হাঁকে মোর দুরন্ত কামনা!
সুদুরিকা! দূরে থাক’-ভালোবাসা-নিকটে এসো না।

তুমি নহ নিভে যাওয়া আলো, নহ শিখা।
তুমি মরীচিকা,
তুমি জ্যোতি।-
জন্ম-জন্মান্তর ধরি’ লোকে-লোকান্তরে তোমা’ করেছি আরতি,
বারে বারে একই জন্মে শতবার করি!
যেখানে দেখেছি রূপ,-করেছি বন্দনা প্রিয়া তোমারেই স্মরি’।
রূপে রূপে, অপরূপা, খুঁজেছি তোমায়,
পবনের যবনিকা যত তুলি তত বেড়ে যায়!
বিরহের কান্না-ধোওয়া তৃপ্ত হিয়া ভরি’
বারে বারে উদিয়াছ ইন্দ্রধনুসমা,
হাওয়া-পরী
প্রিয় মনোরমা!
ধরিতে গিয়োছি-তুমি মিলায়েছ দূর দিগ্বলয়ে
ব্যথা-দেওয়া রাণী মোর, এলে না ক’ কথা কওয়া হ’য়ে।

চির-দূরে থাকা ওগো চির-নাহি-আসা!
তোমারে দেহের তীরে পাবার দুরাশা
গ্রহ হ’তে গ্রহান্তরে ল’য়ে যায় মোরে!
বাসনার বিপুল আগ্রহে-
জন্ম লভি লোকে-লোকান্তরে!
উদ্বেলিত বুকে মোর অতৃপ্ত যৌবন-ক্ষুধা
উদগ্র কামনা,
জন্ম তাই লভি বারে বারে,
না-পাওয়ার করি আরাধনা!….
যা-কিছু সুন্দর হেরি’ ক’রেছি চুম্বন,
যা-কিছু চুম্বন দিয়া ক’রেছি সুন্দর-
সে-সবার মাঝে যেন তব হরষণ
অনুভব করিয়াছি!-ছুঁয়েছি অধর
তিলোত্তমা, তিলে তিলে!
তোমারে যে করেছি চুম্বন
প্রতি তরুণীর ঠোঁটে
প্রকাশ গোপন।

যে কেহ প্রিয়ারে তার চুম্বিয়াছে ঘুম-ভাঙা রাতে,
রাত্রি-জাগা তন্দ্রা-লাগা ঘুম-পাওয়া প্রাতে,
সকলের সাথে আমি চুমিয়াছি তোমা’
সকলের ঠোঁটে যেন, হে নিখিল-প্রিয়া প্রিয়তমা!
তরু, লতা, পশু, পাখী, সকলের কামনার সাথে
আমার কামনা জাগে,-আমি রমি বিশ্ব-কামনাতে!
বঞ্চিত যাহারা প্রেমে, ভুঞ্জে যারা রতি-
সকলের মাঝে আমি-সকলের প্রেমে মোর গতি!
যে-দিন স্রষ্টার বুকে জেগেছিল আদি সৃষ্টি-কাম,
সেই দিন স্রষ্টা সাথে তুমি এলে, আমি আসিলাম।
আমি কাম, তুমি হ’লে রতি,
তরুণ-তরুণী বুকে নিত্য তাই আমাদের অপরূপ গতি!
কী যে তুমি, কী যে নহ, কত ভাবি-কত দিকে চাই!
নামে নামে, অ-নামিকা, তোমারে কি খুঁজিনু বৃথাই?
বৃথাই বাসিনু ভালো? বৃথা সবে ভালোবাসে মোরে?
তুমি ভেবে যারে বুকে চেপে ধরি সে-ই যায় স’রে।
কেন হেন হয়, হায়, কেন লয় মনে-
যারে ভালো বাসিলাম, তারো চেয়ে ভালো কেহ
বাসিছে গোপনে।

সে বুঝি সুন্দরতর-আরো আরো মধু!
আমারি বধূর বুকে হাসো তুমি হ’য়ে নববধূ।
বুকে যারে পাই, হায়,
তারি বুকে তাহারি শয্যায়
নাহি-পাওয়া হ’য়ে তুমি কাঁদ একাকিনী,
ওগো মোর প্রিয়ার সতিনী।….
বারে বারে পাইলাম-বারে বারে মন যেন কহে-
নহে, এ সে নহে!
কুহেলিকা! কোথা তুমি? দেখা পাব কবে?
জন্মেছিলে জন্মিয়াছ কিম্বা জন্ম লবে?
কথা কও, কও কথা প্রিয়া,
হে আমার যুগে-যুগে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া!

কহিবে না কথা তুমি! আজ মনে হয়,
প্রেম সত্য চিরন্তন, প্রেমের পাত্র সে বুঝি চিরন্তন নয়।
জন্ম যার কামনার বীজে
কামনারই মাঝে সে যে বেড়ে যায় কল্পতরু নিজে।
দিকে দিকে শাখা তার করে অভিযান,
ও যেন শুষিয়া নেবে আকাশের যত বায়ু প্রাণ।
আকাশ ঢেকেছে তার পাখা
কামনার সবুজ বলাকা!

প্রেম সত্য, প্রেম-পাত্র বহু-আগণন,
তাই-চাই, বুকে পাই, তবু কেন কেঁদে ওঠে মন।
মদ সত্য, পাত্র সত্য নয়!
যে-পাত্রে ঢালিয়া খাও সেই নেশা হয়!
চির-সহচরী!
এতদিনে পরিচয় পেনু, মরি মরি!
আমারি প্রেমের মাঝে রয়েছ গোপন,
বৃথা আমি খুঁজে মরি’ জন্মে জন্মে করিনু রোদন।
প্রতি রূপে, অপরূপা, ডাক তুমি,
চিনেছি তোমায়,
যাহারে বাসিব ভালো-সে-ই তুমি,
ধরা দেবে তায়!
প্রেম এক, প্রেমিকা সে বহু,
বহু পাত্রে ঢেলে পি’ব সেই প্রেম-
সে শরাব লোহু।
তোমারে করিব পান, অ-নামিকা, শত কামনায়,
ভৃঙ্গারে, গোলাসে কভু, কভু পেয়ালায়!

_______________________________________________________________
কান্ডারী হুশিয়ার!

দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!

দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।

তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার

গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!
কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!

কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।

ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!

কবিতার বিষয়: জীবনমুখী কবিতা, দেশাত্মবোধক কবিতা, যুদ্ধের কবিতা
___________________________________________________________

হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক


হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই
ভারতের দুই আঁখি তারা
এক বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদম চারা।।

যেন গঙ্গা সিন্ধু নদী
যায় গো বয়ে নিরবধি
এক হিমালয় হতে আসে, এক সাগরে হয় গো হারা।।

বুলবুল আর কোকিল পাখী
এক কাননে যায় গো ডাকি,
ভাগীরথী যমুনা বয় মায়ের চোখের যুগল ধারা।।

ঝগড়া করে ভায়ে ভায়ে
এক জননীর কোল লয়ে
মধুর যে এ কলহ ভাই পিঠোপিঠী ভায়ের পারা।।

পেটে ধরা ছেলের চেয়ে চোখে ধরারা মায়া বেশী,
অতিথী ছিল অতীতে, আজ সে সখা প্রতিবেশী।
ফুল পাতিয়ে গোলাপ বেলী
একই মায়ের বুকে খেলি,
পাগলা তা'রা আল্লা ভগবানে ভাবে ভিন্ন যারা।।
কবিতার বিষয়: মানবতাবাদী কবিতা
___________________________________________________________


সাম্যবাদী


গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি?- পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্‌ফুসিয়াস্‌? চার্বআখ চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত সখ-
কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? -পথে ফুটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃষয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
কেন খুঁজে ফের’ দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি -কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!

বন্ধু, বলিনি ঝুট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।
এই হৃদ্য়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম্‌ এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
মস্‌জিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে ব’সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,
এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা।
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি’।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহবান,
এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।
কবিতার বিষয়: মানবতাবাদী কবিতা
__________________________________________________________



সংকল্প


থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,-
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,
কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণারে।।

কেমন করে বীর ডুবুরী সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে,
কেমন করে দুঃসাহসী চলছে উড়ে স্বরগ পানে।
জাপটে ধরে ঢেউয়ের ঝুঁটি
যুদ্ধ-জাহাজ চলছে ছুটি,
কেমন করে আঞ্ছে মানিক বোঝাই করে সিন্ধু-যানে,
কেমন জোরে টানলেসাগর উথলে ওঠে জোয়ার বানে।

কেমন করে মথলে পাথার লক্ষী ওঠেন পাতাল ফুঁড়ে,
কিসের অভিযানে মানুষ চলছে হিমালয় চুড়ে।
তুহিন মেরু পার হয়ে যায়
সন্ধানীরা কিসের আশায়;
হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পুরেঃ
শুনবো আমি, ইঙ্গিত কোন 'মঙ্গল' হতে আসছে উড়ে।।

কোন বেদনার টিকিট কেটে চন্ডু-খোর এ চীনের জাতি
এমন করে উদয়-বেলায় মরণ-খেলায় ওঠল মাতি।
আয়ার্ল্যান্ড আজ কেমন করে
স্বাধীন হতে চলছে ওরেঃ
তুরষ্ক ভাই কেমন করে কাঁটল শিকল রাতারাতি!
কেমন করে মাঝ গগনে নিবল গ্রীসের সূর্য-বাতি।।

রইব না কো বদ্ধ খাঁচায়, দেখব এ-সব ভুবন ঘুরে-
আকাশ বাতাস চন্দ্র-তারায় সাগর-জলে পাহাড়-চুঁড়ে।
আমার সীমার বাঁধন টুটে
দশ দিকেতে পড়ব লুটেঃ
পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়েঃ
বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।।
কবিতার বিষয়: ছোটদের ছড়া-কবিতা, জীবনমুখী কবিতা
__________________________________________________________

অবেলার ডাক


অনেক ক’রে বাসতে ভালো পারিনি মা তখন যারে,
      আজ অবেলায় তারেই মনে পড়ছে কেন বারে বারে।।
      আজ মনে হয় রোজ রাতে সে ঘুম পাড়াত নয়ন চুমে,
     চুমুর পরে চুম দিয়ে ফের হান্‌তে আঘাত ভোরের ঘুমে।
                  ভাব্‌তুম তখন এ কোন্‌ বালাই!
                   কর্‌ত এ প্রাণ পালাই পালাই।
      আজ সে কথা মনে হ’য়ে ভাসি অঝোর নয়ন-ঝরে।
     অভাগিনীর সে গরব আজ ধূলায় লুটায় ব্যথার ভারে।।
     তরুণ তাহার ভরাট বুকের উপ্‌চে-পড়া আদর সোহাগ
   হেলায় দু’পায় দ’লেছি মা, আজ কেন হায় তার অনুরাগ?
                     এই চরণ সে বক্ষে চেপে
                    চুমেছে, আর দু’চোখ ছেপে
       জল ঝ’রেছে, তখনো মা কইনি কথা অহঙ্কারে,
     এম্‌নি দারুণ হতাদরে ক’রেছি মা, বিদায় তারে।।
   দেখেওছিলাম বুক-ভরা তার অনাদরের আঘাত-কাঁটা,
      দ্বার হ’তে সে গেছে দ্বারে খেয়ে সবার লাথি-ঝাটা।
                    ভেবেছিলাম আমার কাছে
                    তার দরদের শানি- আছে,
   আমিও গো মা ফিরিয়ে দিলাম চিন্‌তে নেরে দেবতারে।
       ভিক্ষুবেশে এসেছিল রাজাধিরাজ দাসীর দ্বারে।।
   পথ ভুলে সে এসেছিল সে মোর সাধের রাজ-ভিখারী,
    মাগো আমি ভিখারিনী, আমি কি তাঁয় চিন্‌তে পারি?
                  তাই মাগো তাঁর পূজার ডালা
                    নিইনি, নিইনি মণির মালা,
   দেব্‌তা আমার নিজে আমায় পূজল ষোড়শ-উপচারে।
     পূজারীকে চিন্‌লাম না মা পূজা-ধূমের অন্ধকারে।।
আমায় চাওয়াই শেষ চাওয়া তার মাগো আমি তা কি জানি?
       ধরায় শুধু রইল ধরা রাজ-অতিথির বিদায়-বাণী।
                     ওরে আমার ভালোবাসা!
                      কোথায় বেঁধেছিলি বাসা
       যখন আমার রাজা এসে দাঁড়িয়েছিল এই দুয়ারে?
   নিঃশ্বসিয়া উঠছে ধরা, ‘নেই রে সে নেই, খুঁজিস কারে!’
     সে যে পথের চির-পথিক, তার কি সহে ঘরের মায়া?
       দূর হ’তে মা দূরন-রে ডাকে তাকে পথের ছায়া।
                     মাঠের পারে বনের মাঝে
                     চপল তাহার নূপুর বাজে,
   ফুলের সাথে ফুটে বেড়ায়, মেঘের সাথে যায় পাহাড়ে,
    ধরা দিয়েও দেয় না ধরা জানি না সে চায় কাহারে?
   মাগো আমায় শক্তি কোথায় পথ-পাগলে ধ’রে রাখার?
    তার তরে নয় ভালোবাসা সন্ধ্যা-প্রদীপ ঘরে ডাকার।
                   তাই মা আমার বুকের কবাট
                   খুলতে নারল তার করাঘাত,
    এ মন তখন কেমন যেন বাসত ভালো আর কাহারে,
      আমিই দূরে ঠেলে দিলাম অভিমানী ঘর-হারারে।।
     সোহাগে সে ধ’রতে যেত নিবিড় ক’রে বক্ষে চেপে,
     হতভাগী পারিয়ে যেতাম ভয়ে এ বুক উঠ্‌ত কেঁপে।
                    রাজ ভিখারীর আঁখির কালো,
                    দূরে থেকেই লাগ্‌ত ভালো,
   আসলে কাছে ক্ষুধিত তার দীঘল চাওয়া অশ্র”-ভারে।
  ব্যথায় কেমন মুষড়ে যেতাম, সুর হারাতাম মনে তরে।।
   আজ কেন মা তারই মতন আমারো এই বুকের ক্ষুধা
   চায় শুধু সেই হেলায় হারা আদর-সোহাগ পরশ-সুধা,
                   আজ মনে হয় তাঁর সে বুকে
                    এ মুখ চেপে নিবিড় সুখে
  গভীর দুখের কাঁদন কেঁদে শেষ ক’রে দিই এ আমারে!
যায় না কি মা আমার কাঁদন তাঁহার দেশের কানন-পারে?
   আজ বুঝেছি এ-জনমের আমার নিখিল শানি–আরাম
  চুরি ক’রে পালিয়ে গেছে চোরের রাজা সেই প্রাণারাম।
                  হে বসনে-র রাজা আমার!
               নাও এসে মোর হার-মানা-হারা!
   আজ যে আমার বুক ফেটে যায় আর্তনাদের হাহাকারে,
দেখে যাও আজ সেই পাষাণী কেমন ক’রে কাঁদতে পারে!
    তোমার কথাই সত্য হ’ল পাষাণ ফেটেও রক্ত বহে,
     দাবাললের দার”ণ দাহ তুষার-গিরি আজকে দহে।
                    জাগল বুকে ভীষণ জোয়ার,
                    ভাঙল আগল ভাঙল দুয়ার
    মূকের বুকে দেব্‌তা এলেন মুখর মুখে ভীম পাথারে।
    বুক ফেটেছে মুখ ফুটেছে-মাগো মানা ক’র্‌ছ কারে?
     স্বর্গ আমার গেছে পুড়ে তারই চ’লে যাওয়ার সাথে,
  এখন আমার একার বাসার দোসরহীন এই দুঃখ-রাতে।
                   ঘুম ভাঙাতে আস্‌বে না সে
                 ভোর না হ’তেই শিয়র-পাশে,
     আস্‌বে না আর গভীর রাতে চুম-চুরির অভিসারে,
    কাঁদাবে ফিরে তাঁহার সাথী ঝড়ের রাতি বনের পারে।
  আজ পেলে তাঁয় হুম্‌ড়ি খেয়ে প’ড়তুম মাগো যুগল পদে,
    বুকে ধ’রে পদ-কোকনদ স্নান করাতাম আঁখির হ্রদে।
                  ব’সতে দিতাম আধেক আঁচল,
                  সজল চোখের চোখ-ভরা জল-
    ভেজা কাজল মুছতাম তার চোখে মুখে অধর-ধারে,
    আকুল কেশে পা মুছাতাম বেঁধে বাহুর কারাগারে।
    দেখ্‌তে মাগো তখন তোমার রাক্ষুসী এই সর্বনাশী,
   মুখ থুয়ে তাঁর উদার বুকে ব’লত,‘ আমি ভালোবাসি!’
                    ব’ল্‌তে গিয়ে সুখ-শরমে
                  লাল হ’য়ে গাল উঠত ঘেমে,
  বুক হ’তে মুখ আস্‌ত নেমে লুটিয়ে যখন কোল-কিনারে,
দেখ্‌তুম মাগো তখন কেমন মান ক’রে সে থাক্‌তে পারে!
    এম্‌নি এখন কতই আমা ভালোবাসার তৃষ্ণা জাগে
    তাঁর ওপর মা অভিমানে, ব্যাথায়, রাগে, অনুরাগে।
                   চোখের জলের ঋণী ক’রে,
                   সে গেছে কোন্‌ দ্বীপান-রে?
     সে বুঝি মা সাত সমুদ্দুর তের নদীর সুদূরপারে?
  ঝড়ের হাওয়া সেও বুঝি মা সে দূর-দেশে যেতে নারে?
    তারে আমি ভালোবাসি সে যদি তা পায় মা খবর,
  চৌচির হ’য়ে প’ড়বে ফেটে আনন্দে মা তাহার কবর।
                 চীৎকারে তার উঠবে কেঁপে
                  ধরার সাগর অশ্রু ছেপে,
     উঠবে ক্ষেপে অগ্নি-গিরি সেই পাগলের হুহুঙ্কারে,
  ভূধর সাগর আকাশ বাতাস ঘুর্ণি নেচে ঘিরবে তারে।
  ছি, মা! তুমি ডুকরে কেন উঠছ কেঁদে অমন ক’রে?
তার চেয়ে মা তারই কোনো শোনা-কথা শুনাও মোরে!
                শুনতে শুনতে তোমার কোলে
                 ঘুমিয়ে পড়ি। - ও কে খোলে
   দুয়ার ওমা? ঝড় বুঝি মা তারই মতো ধাক্কা মারে?
ঝোড়ো হওয়া! ঝোড়ো হাওয়া! বন্ধু তোমার সাগর পারে!
   সে কি হেথায় আসতে পারে আমি যেথায় আছি বেঁচে,
  যে দেশে নেই আমার ছায়া এবার সে সেই দেশে গেছে!
                    তবু কেন থাকি’ থাকি’,
                    ইচ্ছা করে তারেই ডাকি!
   যে কথা মোর রইল বাকী হায় সে কথা শুনাই কারে?
  মাগো আমার প্রাণের কাঁদন আছড়ে মরে বুকের দ্বারে!
   যাই তবে মা! দেখা হ’লে আমার কথা ব’লো তারে-
   রাজার পূজা-সে কি কভু ভিখারিনী ঠেলতে পারে?
                   মাগো আমি জানি জানি,
                   আসবে আবার অভিমানী
  খুঁজতে আমায় গভীর রাতে এই আমাদের কুটীর-দ্বারে,
    ব’লো তখন খুঁজতে তারেই হারিয়ে গেছি অন্ধকারে!

কবিতার বিষয়: প্রেমের কবিতা, বিরহের কবিতা
__________________________________________________________

অভিশাপ

যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে -
          বুঝবে সেদিন বুঝবে!
     ছবি আমার বুকে বেঁধে
     পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে
     ফিরবে মরু কানন গিরি,
     সাগর আকাশ বাতাস চিরি'
          যেদিন আমায় খুঁজবে -
          বুঝবে সেদিন বুঝবে!

স্বপন ভেঙে নিশুত্ রাতে জাগবে হঠাৎ চমকে,
কাহার যেন চেনা-ছোওয়ায় উঠবে ও-বুক ছমকে, -
          জাগবে হঠাৎ চমকে!
     ভাববে বুঝি আমিই এসে
     ব'সনু বুকের কোলটি ঘেঁষে,
     ধরতে গিয়ে দেখবে যখন
     শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন!
          বেদনাতে চোখ বুজবে -
          বুঝবে সেদিন বুঝবে!

গাইতে ব'সে কন্ঠ ছিড়ে আসবে যখন কান্না,
ব'লবে সবাই - "সেই যে পথিক, তার শেখানো গান না?"
          আসবে ভেঙে কান্না!
     প'ড়বে মনে আমার সোহাগ,
     কন্ঠে তোমার কাঁদবে বেহাগ!
     প'ড়বে মনে অনেক ফাঁকি
     অশ্রু-হারা কঠিন আঁখি
          ঘন ঘন মুছবে -
          বুঝবে সেদিন বুঝবে!

আবার যেদিন শিউলি ফুটে ভ'রবে তোমার অঙ্গন,
তুলতে সে-ফুল গাঁথতে মালা কাঁপবে তোমার কঙ্কণ -
          কাঁদবে কুটীর-অঙ্গন!
     শিউলি ঢাকা মোর সমাধি
     প'ড়বে মনে, উঠবে কাঁদি'!
     বুকের মালা ক'রবে জ্বালা
     চোখের জলে সেদিন বালা
          মুখের হাসি ঘুচবে -
          বুঝবে সেদিন বুঝবে!
কবিতার বিষয়: বিরহের কবিতা
__________________________________________________________

আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে

আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে–
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।

আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে -
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে।
আসল হাসি, আসল কাঁদন
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে।
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে -
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ
সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস,
ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস,
গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে!
ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে
চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,

আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন,
মদন মারে খুন-মাখা তূণ
পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল
ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে
গো দিগ বালিকার পীতবাসে;

আজ রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!
আজ কপট কোপের তূণ ধরি,
ঐ আসল যত সুন্দরী,
কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন,
কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে!
তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে
ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের
আমার চোখে জল আসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!

আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর,
আসল নিকট, আসল সুদূর
আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন
পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে!
ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল
হাসল শিশির দুবঘাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

আজ জাগল সাগর, হাসল মরু
কাঁপল ভূধর, কানন তরু
বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান
ভৈরবীদের গান ভাসে,
মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।

মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে।
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!
কবিতার বিষয়: বিবিধ কবিতা, রূপক কবিতা
___________________________________________________________

আনন্দময়ীর আগমনে

 


আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?

মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি
খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।
ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা,
মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা।

তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে
রক্ত-তৃষার 'ময়-ভুখা-হু'র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।-
অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা,
আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা।
দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা
দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।..

'ময় ভুখা হুঁ মায়ি' বলে আয় এবার আনন্দময়ী
কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!
কবিতার বিষয়: ধর্মীয় কবিতা, যুদ্ধের কবিতা
__________________________________________________________

আমাদের নারী

গুনে গরিমায় আমাদের নারী আদর্শ দুনিয়ায়।
রূপে লাবন্যে মাধুরী ও শ্রীতে হুরী পরী লাজ পায়।।
নর নহে, নারী ইসলাম পরে প্রথম আনে ঈমান,
আম্মা খাদিজা জগতে সর্ব-প্রথম মুসলমান,
পুরুষের সব গৌরবস্নান এক এই  মহিমায়।।
নবী নন্দিনী ফাতেমা মোদের সতী নারীদের রাণী,
যাঁর ত্যাগ সেবা স্নেহ ছিল মরূভুমে কওসর পানি,
যাঁর গুণ-গাথা ঘরে ঘরে প্রতি  নর-নারী আজো গায়।।
রহিমার মত মহিমা কাহার, তাঁর সম সতী কেবা,
নারী নয় যেন মূর্তি ধরিয়া এসেছিল পতি সেবা
মোদের খাওয়ালা জগতের আলা বীরত্বে গরিমায়।।
রাজ্য শাসনের রিজিয়ার নাম ইতিহাসে অক্ষয়,
শৌর্যে সাহসে চাঁদ সুলতানা বিশ্বের বিস্ময়।
জেবুন্নেসার তুলনায় কোথায় জ্ঞানের তাপস্যার।।
বারো বছরের বালিকা লায়লা ওহাবীব দলপতি
মোদের সাকিনা জাহানারা যেন ধৈর্য মূর্তিমতী,
সে গৌরবের গোর হয়ে গেছে আঁধারের বোরকায়।।
আঁধার হেরেমে বন্দিনী হলো সহসা আলোর মেয়ে,
সেই দিন হতে ইসলাম গেল গ্লানির কালিতে ছেয়ে
লক্ষ খালিদা আসিবে, যদি এ নারীরা মুক্তি পায়।।
কবিতার বিষয়: জীবনমুখী কবিতা, মানবতাবাদী কবিতা
__________________________________________________________

আমার কৈফিয়ৎ

বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!

কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে!
বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’।
পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা।
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা।
কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে!
কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!

গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!

মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্‌-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’

আনকোরা যত নন্‌ভায়োলেন্ট নন্‌-কো’র দলও নন্‌ খুশী।
‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্‌’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি!
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
‘নয় চর্‌কার গান কেন গা’বে?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্‌ফুসি!
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!

নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী!
‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘ এই তব বিদ্যে, ছি!’
ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’-
যুগের না হই, হজুগের কবি
বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ্‌-পেশী,
দু’কানে চশ্‌মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্‌ বেশী!

কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু?
হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু!
বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম,
রাজ-সরকার রেখেছেন মান!
যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু
শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?

বন্ধু! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে,
হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে!
যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল,
মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল,
তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে।
হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’!

আমি বলি, ওরে কথা শোন্‌ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্‌ খোশ্‌-হালে!
প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস্‌, এবার এ দাঁও ফস্‌কালে
‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়!
বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায়
গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে
নিস্‌ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।

বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে,
গান শুন সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেয়ে!
রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী,
স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী,
চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে।
মাতা কয়, ওরে চুপ্‌ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্‌ চেয়ে!

ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?

আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস!
কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস
এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ!
টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ।
মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস!
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!

বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!

পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!
কবিতার বিষয়: জীবনমুখী কবিতা, বিবিধ কবিতা
__________________________________________________________

আশীর্বাদ




 আপনার ঘরে আছে যে শত্রু
তারে আগে করো জয়,
ভাঙো সে দেয়াল, প্রদীপের আলো
যাহা আগুলিয়া রয়।
অনাত্বীয়রে আত্বীয় করো,
তোমার বিরাট প্রাণ
করে না কো যেন কোনোদিন কোনো
মানুষে অসম্মান।
সংসারের মিথ্যা বাঁধন
ছিন্ন হোক আগে,
কবে সে তোমার সকল দেউল
রাঙিবে আলোর রাগে।

__________________________________________________________

উমর ফারুক

তিমির রাত্রি - 'এশা'র আযান শুনি দূর মসজিদে।
প্রিয়-হারা কার কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়ে বিঁধে!

                     আমির-উল-মুমেনিন,
তোমার স্মৃতি যে আযানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন।
তকবির শুনি, শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি,
বাতায়নে চাই-উঠিয়াছে কি-রে গগনে মরুর শশী?
ও-আযান, ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান?
মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ও কি ও তোমারি সে আহ্ববান?

                     আবার লুটায়ে পড়ি।
'সেদিন গিয়াছে' - শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি।
উমর! ফারুক! আখেরি নবীর ওগো দক্ষিণ-বাহু!
আহ্বান নয় - রূপ ধরে এস - গ্রাসে অন্ধতা-রাহু!
ইসলাম-রবি, জ্যোতি তার আজ দিনে দিনে বিমলিন!
সত্যের আলো  নিভিয়া-জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ।
শুধু অঙ্গুলি-হেলনে শাসন করিতে এ জগতের
দিয়াছিলে ফেলি মুহম্মদের চরণে যে-শমশের
ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এস তুমি সেই শমশের ধরি
আর একবার লোহিত-সাগরে লালে-লাল হয়ে মরি!

ইসলাম - সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি?
পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি।
আজ বুঝি - কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর-
'মোরপরে যদি নবী হত কেউ, হত সে এক উমর।'
*  *  *  *  *  *  *  *  *  *
অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখতে বসি
খেজুরপাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি
সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক' নুয়ে,
ঊর্ধ্বের যারা - পড়ছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভূঁয়ে।
শত প্রলোভন বিলাস বাসনা ঐশ্বর্যের মদ
করেছে সালাম দূর হতে সব ছুঁইতে পারেনি পদ।
সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমি ছিলে সব নিচে,
বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিলে পিছে।

                     হেরি পশ্চাতে চাহি-
তুমি চলিয়াছ রৌদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি
জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি
বীর মুসলিম সেনাদল তব বহু দিন মাস ধরি।
দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা বলেছে শত্রু শেষে-
উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এসে!
হায় রে, আধেক ধরার মালিক আমির-উল-মুমেনিন
শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন
সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দু খানা শুকনো 'খবুজ' রুটি
একটি  মশকে একটুকু পানি খোর্মা দু তিন মুঠি।
প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি
চলেছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্ট্রের রশি ধরি!
মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে,
সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে।
কিছুদূর যেতে উঠ হতে নামি কহিলে ভৃত্যে, 'ভাই
পেরেশান বড় হয়েছ চলিয়া! এইবার আমি যাই
উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে, তুমি উঠে বস উটে,
তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে।'

                     ...ভৃত্য দস্ত চুমি
কাঁদিয়া কহিল, 'উমর! কেমনে এ আদেশ কর তুমি?
উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি
আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি?'

                     খলিফা হাসিয়া বলে,
'তুমি জিতে গিয়ে বড় হতে চাও, ভাই রে, এমনি ছলে।
রোজ-কিয়ামতে আল্লাহ যে দিন কহিবে, 'উমর! ওরে
করেনি খলিফা, মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে।'
কি দিব জওয়াব, কি করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই।
আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু, মোর অধিকার নাই।
আরাম সুখের, -মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা।
ইসলাম বলে, সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কেবা।

ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি,
মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী।
জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্প বৃষ্টি হইল কিনা,
কি গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দী' বিশ্ববীণা।
জানি না, সেদিন ফেরেশতা তব করেছে কি না স্তব-
অনাগত কাল গেয়েছিল শুধু, 'জয় জয়  হে মানব।'
*  *  *  *  *  *  *  *  *  *
তুমি নির্ভীক, এক খোদা ছাড়া করনি ক' কারে ভয়,
সত্যব্রত তোমায় তাইতে সবে উদ্ধত কয়।
মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষেরি অপমান,
তাই মহাবীর খালদেরে তুমি পাঠাইলে ফরমান,
সিপাহ-সালারে ইঙ্গিতে তব করিলে মামুলি সেনা,
বিশ্ব-বিজয়ী বীরেরে শাসিতে এতটুকু টলিলে না।
*  *  *  *  *  *  *  *  *  *
মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি,
মনে পড়ে তব মহত্ত্ব-কথা - সেদিন সে বিভাবরী
নগর-ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে
মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুদাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরে

কাঁদিতেছে আর দুখিনী মাতা ছেলেরে ভুলাতে হায়,
উনানে শূন্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকুলে চায়।
শুনিয়া সকল - কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে
বায়তুল-মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে,
বলিলে, 'এসব চাপাইয়া দাও আমার পিঠের 'পরে,
আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে'।
কত লোক আসি আপনি চাহিল বহিতে তোমার বোঝা,
বলিলে, 'বন্ধু, আমার এ ভার আমিই বহিব সোজা!
রোজ-কিয়ামতে কে বহিবে বল আমার পাপের ভার?
মম অপরাধে ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদিয়াছে, আজি তার
প্রায়শ্চিত্ত করিব আপনি' - চলিলে নিশীথ রাতে
পৃষ্ঠে বহিয়া খাদ্যের বোঝা দুখিনীর আঙিনাতে!

                     এত যে কোমল প্রাণ,
করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনি ক' অপমান!
মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্রেরে নিজ করে
মেরেছ দোররা, মরেছে পুত্রে তোমার চোখের পরে!
ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি-
'অপরাধ করে তোরি মতো স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী।'

                     আবু শাহমার গোরে
কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে।

খাস দরবার ভরিয়া গিয়াছে হাজার দেশের লোকে,
'কোথায় খলিফা' কেবলি প্রশ্ন ভাসে উৎসুক চোখে,
একটি মাত্র পিরান কাচিয়া শুকায়নি তাহা বলে,
রৌদ্রে ধরিয়া বসিয়া আছে গো খলিফা আঙিনা-তলে।
হে খলিফাতুল-মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট!
অপমান তব করিব না আজ করিয়া  নান্দী পাঠ,
মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই
তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই।

(সংক্ষেপিত)

__________________________________________________________

এক আল্লাহ জিন্দাবাদ

উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ;
আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।
উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ,
আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ।

উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহীদি দরজা চাই;
নিত্য মৃত্যু-ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই!
ওরা মরিবেনা, যুদ্ব বাধিঁলে ওরা লুকাইবে কচুবনে,
দন্তনখরহীন ওরা তবু কোলাহল করে অঙ্গনে।

ওরা নির্জীব; জিব নাড়ে তবু শুধূ স্বার্থ ও লোভবশে,
ওরা জিন, প্রেত, যজ্ঞ, উহারা লালসার পাঁকে মুখ ঘষে।
মোরা বাংলার নব যৌবন,মৃত্যুর সাথে সন্তরী,
উহাদের ভাবি মাছি পিপীলিকা, মারি না ক তাই দয়া করি।

মানুষের অনাগত কল্যাণে উহারা চির অবিশ্বাসী,
অবিশ্বাসীরাই শয়তানী-চেলা ভ্রান্ত-দ্রষ্টা ভুল-ভাষী।
ওরা বলে, হবে নাস্তিক সব মানুষ, করিবে হানাহানি।
মোরা বলি, হবে আস্তিক, হবে আল্লাহ মানুষে জানাজানি।

উহারা চাহুক অশান্তি; মোরা চাহিব ক্ষমাও প্রেম তাহার,
ভূতেরা চাহুক গোর ও শ্মশান, আমরা চাহিব গুলবাহার!
আজি পশ্চিম পৃথিবীতে তাঁর ভীষণ শাস্তি হেরি মানব
ফিরিবে ভোগের পথ ভয়ে, চাহিবে শান্তি কাম্য সব।

হুতুম প্যাচারা কহিছে কোটরে, হইবেনা আর সূর্যোদয়,
কাকে আর তাকে ঠোকরাইবেনা, হোক তার নখ চষ্ণু ক্ষয়।
বিশ্বাসী কভু বলেনা এ কথা, তারা আলো চায়, চাহে জ্যোতি;
তারা চাহে না ক এই উৎপীড়ন এই অশান্তি দূর্গতি।

তারা বলে, যদি প্রার্থনা মোরা করি তাঁর কাছে এক সাথে,
নিত্য ঈদের আনন্দ তিনি দিবেন ধুলির দুনিয়াতে।
সাত আসমান হতে তারা সাত-রঙা রামধনু আনিতে চায়,
আল্লা নিত্য মহাদানী প্রভূ, যে যাহা চায়, সে তাহা পায়।

যারা অশান্তি দুর্গতি চাহে, তারা তাই পাবে, দেখো রে ভাই,
উহারা চলুক উহাদের পথে, আমাদের পথে আমরা যাই।
ওরা চাহে রাক্ষসের রাজ্য, মেরা আল্লার রাজ্য চাই,
দ্বন্দ্ব-বিহীন আনন্দ-লীলা এই পৃথিবীতে হবে সদাই।

মোদের অভাব রবে না কিছুই, নিত্যপূর্ণ প্রভূ মোদের,
শকুন শিবার মত কাড়াকাড়ি করে শবে লয়ে-- শখ ওদের!
আল্লা রক্ষা করুন মোদেরে, ও পথে যেন না যাই কভূ,
নিত্য পরম-সুন্দর এক আল্লাহ্ আমাদের প্রভূ।

পৃথিবীতে যত মন্দ আছে তা ভালো হোক, ভালো হোক ভালো,
এই বিদ্বেষ-আঁধার দুনিয়া তাঁর প্রেমে আলো হোক, আলো।
সব মালিন্য দূর হয়ে যাক সব মানুষের মন হতে,
তাঁহার আলোক প্রতিভাত হোক এই ঘরে ঘরে পথে পথে।

দাঙ্গা বাঁধায়ে লুট করে যারা, তার লোভী, তারা গুন্ডাদল
তারা দেখিবেনা আল্লাহর পথ চিরনির্ভয় সুনির্মল।
ওরা নিশিদিন মন্দ চায়, ওরা নিশিদিন দ্বন্দ চায়,
ভূতেরা শ্রীহীন ছন্দ চায়, গলিত শবের গন্ধ চায়!

তাড়াবে এদের দেশ হতে মেরে আল্লার অনাগত সেনা,
এরাই বৈশ্য, ফসল শৈস্য লুটে খায়, এরা চির চেনা।
ওরা মাকড়সা, ওদের ঘরের ঘেরোয়াতে কভু যেয়ো না কেউ,
পর ঘরে থাকে জাল পেতে, ওরা দেখেনি প্রাণের সাগর ঢেউ।

বিশ্বাস করো এক আল্লাতে প্রতি নিঃশ্বাসে দিনে রাতে,
হবে দুলদুল - আসওয়ার পাবে আল্লার তলোয়ার হাতে।
আলস্য আর জড়তায় যারা ঘুমাইতে চাহে রাত্রিদিন,
তাহারা চাহে না চাঁদ ও সূর্য্য, তারা জড় জীব গ্লানি-মলিন।

নিত্য সজীব যৌবন যার, এস এস সেই নৌ-জোয়ান
সর্ব-ক্লৈব্য করিয়াছে দূর তোমাদেরই চির আত্বদান!
ওরা কাদা ছুড়ে বাঁধা দেবে ভাবে - ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ,
মোরা ফুল ছড়ে মারিব ওদের, বলিব - "এক আল্লাহ জিন্দাবাদ"।
কবিতার বিষয়: ধর্মীয় কবিতা, মানবতাবাদী কবিতা
___________________________________________________________

কারার ঐ লৌহকপাট

কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান,
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ
ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।

গাজনের বাজনা বাজা,
কে মালিক, কে সে রাজা,
কে দেয় সাজা মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?
হা হা হা পায় যে হাসি, ভগবান পরবে ফাঁসি,
সর্বনাশী শিখায় এ হীন তথ্য কে রে!

ওরে ও পাগলা ভোলা,
দে রে দে প্রলয় দোলা,
গারদগুলা জোরসে ধরে হেচ্‌কা টানে
মার হাঁক হায়দারী হাঁক, কাধে নে দুন্দুভি ঢাক
ডাক ওরে ডাক, মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে।

নাচে ওই কালবোশাখী,
কাটাবী কাল বসে কি
দেরে দেখি ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি
লাথি মার ভাঙ্গরে তালা,
যত সব বন্দী শালায়-আগুন-জ্বালা, আগুন-জ্বালা,
ফেল উপাড়ি।।
কবিতার বিষয়: জীবনমুখী কবিতা, মানবতাবাদী কবিতা, যুদ্ধের কবিতা
___________________________________________________________

কোরবানী

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্-বোধন!
  দুর্ব্বল ! ভীরু ! চুপ রহো, ওহো খাম্ খা ক্ষুব্ধ মন!
                ধ্বনি ওঠে রণি’ দূর বাণীর,--
                আজিকার এ খুন কোর্ বানীর!
                দুম্বা-শির           রুম্-বাসীর
   শহীদের শির-সেরা আজি!--  রহ্ মান কি রুদ্র নন?
                ব্যস্!   চুপ খামোশ রোদন!
আজ  শোর ওঠে জোর “খুন দে, জান দে, শির দে বত্স”  শোন্!
ওরে  হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির  উদ্ধোধন!

ওরে        হত্যা নয় আজ  ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্ধোধন!
                খঞ্জরে মারো গর্দ্দানেই,
                পঞ্জরে আজি দরদ্ নেই,
                মর্দ্দানীই             পর্দ্দা নেই,
        ডরতা নেই আজ খুন-খারাবীতে রক্ত-লুব্ধ মন!
                খুনে          খেল্ বো খুন-মাতন!
দুনো        উনমাদনাতে সত্য মুক্তি আন্ তে যুঝবো রণ!
ওরে        হত্যা নয়  আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্ধোধন!

ওরে         হত্যা  নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্ধোধন!
                চ’ড়েছে খুন আজ খুনিয়ারার
                মুস্ লিমে সারা দুনিয়াটার!
                ‘জুল্ ফেকার’     খুল্ বে তার
        দু’ধারী ধার শেরে-খোদার,  রক্তে-পূত-বদন!
                খুনে        আজকে রুধ্ বো মন!
ওরে        শক্তি-হস্তে    মুক্তি , শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন্!
ওরে        হত্যা নয় আজ  ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!

ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্বোধন!
                আস্তানা সিধা রাস্তা নয়,
                ‘আজাদী’ মেলে না পস্তানো’য়!
                দস্তা নয়                সে সস্তা নয়!
         হত্যা নয় কি মৃত্যুও ?          তবে রক্ত-লুব্ধ কোন্
                কাঁদে--     শক্তি-দুস্ত শোন্--
“এয়্        ইবরাহীম আজ  কোরবানী  কর শ্রেষ্ঠ পুত্র ধন!”
ওরে        হত্যা নয় আজ  ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!

ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্ভোধন!
                এ তো নহে লোহু তরবারের
                ঘাতক জালিম জোর্ বারের!
                কোরবানের  জোর-জানের
        খুন এ যে, এতে গোর্দ্দা ঢের রে, এ ত্যাগে ‘বুদ্ধ’ মন!
                এতে মা রাখে পুত্র পণ!
তাই        জননী হাজেরা বেটারে পরালো বলির পূত বসন!
ওরে         হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন

ওরে         হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্বোধন!
                এই দিন-ই ‘মীনা’- ময়দানে’
                পুত্র-স্নেহের গর্দ্দানে
                ছুরি হেনে’ খুন ক্ষরিয়ে নে’
        রেখেছে আব্বা ইব্ রাহীম্ সে আপনা রুদ্র পণ!
                ছি ছি!  কেঁপো না  ক্ষুদ্র মন
আজ        জল্লাদ নয়,  প্রহ্লাদ-সম মোল্লা খুন-বদন !
ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্বোধন!

ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
দ্যাখ        কেঁপেছে ‘আরশ’ আস্ মানে!
                মন-খুনী কি  রে রাশ মানে?
                ত্রাসে-প্রাণে -- তবে রাস্তা নে!
প্রলয়-বিষাণ ‘কিয়ামতে’  তবে বাজাবে কোন্ বোধন?
                সে কি                    সৃষ্টি-সংশোধন?
ওরে         তাথিয়া তাথিয়া নাচে ভৈরব বাজে ডম্বরু শোন্!--
ওরে         হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!

ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্বোধন!
                মুসলিম-রণ-ডঙ্কা সে,
                খুন্ দেখে করে শঙ্কা কে?
                টঙ্কারে অসি ঝঙ্কারে,
ওরে        হুঙ্কারে, ভাঙি গড়া ভীম-কারা, ল’ড়বো রণ-মরণ!
                ঢালে বাজ্ বে ঝন্-ঝনন্!
ওরে        সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন!
ওরে         হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!

ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’   শক্তির উদ্বোধন!
                জোর চাই, আর যাচ্ না নয়,
                কোরবানী-দিন আজ না ওই?
                বাজ্ না কই ?   সাজ্ না কই?
        কাজ না আজিকে জান্ মাল দিয়ে মুক্তির উদ্ধরণ?
                বল্-- “যুঝ্ বো জান্ ভি পণ!”
ঐ          খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ,
আজ       আল্লার নামে জান্ কোরবানে ঈদের পূত বোধন!
ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!


উৎস: অগ্নিবীণা

__________________________________________________________

কবি-রাণী

তুমি আমায় ভালোবাসো তাই তো আমি কবি।
আমার এ রূপ-সে যে তোমায় ভালোবাসার ছবি।।
আপন জেনে হাত বাড়ালো-
আকাশ বাতাস প্রভাত-আলো,
বিদায়-বেলার সন্ধ্যা-তারা
পুবের অরুণ রবি,-
তুমি ভালোবাস ব’লে ভালোবাসে সবি?

আমার আমি লুকিয়েছিল তোমার ভালোবাসায়,
তুমিই আমার মাঝে আসি’
অসিতে মোর বাজাও বাঁশি,
আমার পূজার যা আয়োজন
তোমার প্রাণের হবি।
আমার বাণী জয়মাল্য, রাণি! তোমার সবি।।

তুমি আমায় ভালোবাস তাই তো আমি কবি।
আমার এ রূপ-সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।।
কবিতার বিষয়: প্রেমের কবিতা
___________________________________________________________

কুলি-মজুর

দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
          চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,
বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্‌?
রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা?-ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি হঁটে আছে লিখা।
তুমি জান না ক’, কিন- পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!

          আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
তুমি শুয়ে র’বে তেতালার পরে আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে!
সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে
এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে!
তারি পদরজ অঞ্জলি করি’ মাথায় লইব তুলি’,
সকলের সাথে পথে চলি’ যার পায়ে লাগিয়াছে ধূলি!
আজ নিখিলের বেদনা -আর্ত পীড়িতের মাখি’ খুন,
লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ!
আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্‌ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!
সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়-ক আমাদের এই  ঘরে,
মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়-ক ঝ’রে।
সকল কালের  সকল দেশের সকল মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
          একজনে দিলে ব্যথা-
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
          একের  অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,
উর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান!
কবিতার বিষয়: মানবতাবাদী কবিতা
 __________________________________________________________

ছাত্রদলের গান

আমরা শক্তি আমরা বল
                        আমরা ছাত্রদল।
মোদের         পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান
                        ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।
                                আমরা ছাত্রদল।।

মোদের         আঁধার রাতে বাধার পথে
                        যাত্রা নাঙ্গা পায়,
আমরা                শক্ত মাটী রক্তে রাঙাই
                        বিষম চলার ঘাস।
                যুগে যুগে রক্তে মোদের
                        সিক্ত হ’ল পৃথ্বীতল।
                                 আমরা ছাত্রদল।।

মোদের         কক্ষচ্যুত-ধূমকেতু-- প্রায়
                         লক্ষ্যহারা প্রাণ
আমরা                ভাগ্যদেবীর  যজ্ঞবেদীর
                        নিত্য বলিদান।
যখন                লক্ষ্মীদেবী  স্বর্গে উঠেন
                        আমরা পশি নীল অতল!
                                   আমরা ছাত্রদল।।

আমরা                 ধরি মৃত্যু রাজার
                        যজ্ঞ-ঘোড়ার রাশ,
মোদের         মৃত্যু লেখে মোদের
                        জীবন--ইতিহাস!
            হাসির দেশে আমরা আনি
                        সর্বনাশী চোখের জল
                               আমরা ছাত্রদল।।

                সবাই যখন বুদ্ধি যোগায়
                        আমরা করি ভুল!
                সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব,
                        আমরা ভাঙি কূল।
                দারুণ-রাতে আমরা তরুণ
                        রক্তে করি পথ পিছল!
                                   আমরা ছাত্রদল।।        

মোদের                চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল,
                        বক্ষে ভরা বাক্,
                কন্ঠে মোদের কুন্ঠাবিহীন
                        নিত্য কালের ডাক।
আমরা                তাজা খুনে লাল ক’রেছি
                        সরস্বতীর শ্বেত কমল।
                                    আমরা ছাত্রদল।।        

ঐ                দারুণ উপপ্লবের দিনে
                        আমরা দানি শির,
                মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে
                        বিংশ শতাব্দীর!
মোরা                গৌরবেরি কান্না দিয়ে
                        ভ’রেছি মা’র শ্যাম-আঁচল।
                                আমরা ছাত্রদল।

                আমরা রচি ভালোবাসার
                        আশার ভবিষ্যৎ,
মোদের                স্বর্গ-পথের অভাস দেখায়
                        আকাশ-ছায়াপথ!
                মোদের চোখে বিশ্ববাসীর
                        স্বপ্ন দেখা হোক সফল।
                                আমরা ছাত্রদল।।
কবিতার বিষয়: ছোটদের ছড়া-কবিতা, মানবতাবাদী কবিতা
___________________________________________________________

জাগরণী

জাগো রে তরুণ জাগো রে ছাত্রদল
স্বতঃ উৎসারিত ঝর্ণাধারায় প্রায় জাগো প্রাণ-চঞ্চল
ভেদ-বিভেদের গ্লানির কারা-প্রাচীর
ধুলিসাৎ করি জাগো উন্নত শির
জবাকুসুম-সঙ্কাশ জাগে বীর,
বিধি নিষেধের ভাঙ্গো ভাঙ্গো অর্গল।
ধর্ম বর্ণ জাতির ঊর্ধ্বে জাগো রে নবীন প্রাণ
তোমার অভ্যুদয়ে হোক সব বিরোধের অবসান
সঙ্কীর্ণতা ক্ষুদ্রতা ভোলো ভোলো
সকল মানুষে ঊর্ধ্বে ধরিয়া তোলো
তোমাদের চাহে আজ নিখিল জনসমাজ
আনো জ্ঞানদীপ এই তিমিরের মাঝ,
বিধাতার সম জাগো প্রেম প্রোজ্জ্বল।
 __________________________________________________________


দারিদ্র্য

হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান্‌।
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান
কন্টক-মুকুট শোভা।-দিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,
বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার!
দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস,
অম্লান স্বর্ণেরে মোর করিলে বিরস,
অকালে শুকালে মোর রূপ রস প্রাণ!
শীর্ণ করপুট ভরি’ সুন্দরের দান
যতবার নিতে যাই-হে বুভুক্ষু তুমি
অগ্রে আসি’ কর পান! শূন্য মরুভূমি
হেরি মম কল্পলোক। আমার নয়ন
আমারি সুন্দরে করে অগ্নি বরিষণ!

বেদনা-হলুদ-বৃন্ত কামনা আমার
শেফালির মত শুভ্র সুরভি-বিথার
বিকশি’ উঠিতে চাহে, তুমি হে নির্মম,
দলবৃন্ত ভাঙ শাখা কাঠুরিয়া সম!
আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল
ক’রে ওঠে সারা হিয়া, শিশির সজল

টলটল ধরণীর মত করুণায়!
তুমি রবি, তব তাপে শুকাইয়া যায়
করুণা-নীহার-বিন্দু! ম্লান হ’য়ে উঠি
ধরণীর ছায়াঞ্চলে! স্বপ্ন যায় টুটি’
সুন্দরের, কল্যাণের। তরল গরল
কন্ঠে ঢালি’ তুমি বল, ‘অমৃতে কি ফল?
জ্বালা নাই, নেশা নাই. নাই উন্মাদনা,-
রে দুর্বল, অমরার অমৃত-সাধনা
এ দুঃখের পৃথিবীতে তোর ব্রত নহে,
তুই নাগ, জন্ম তোর বেদনার দহে।
কাঁটা-কুঞ্জে বসি’ তুই গাঁথিবি মালিকা,
দিয়া গেনু ভালে তোর বেদনার টিকা!….
গাহি গান, গাঁথি মালা, কন্ঠ করে জ্বালা,
দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ-নাগবালা!….

ভিক্ষা-ঝুলি নিয়া ফের’ দ্বারে দ্বারে ঋষি
ক্ষমাহীন হে দুর্বাসা! যাপিতেছে নিশি
সুখে রব-বধূ যথা-সেখানে কখন,
হে কঠোর-কন্ঠ, গিয়া ডাক-‘মূঢ়, শোন্‌,
ধরণী বিলাস-কুঞ্জ নহে নহে কারো,
অভাব বিরহ আছে, আছে দুঃখ আরো,
আছে কাঁটা শয্যাতলে বাহুতে প্রিয়ার,
তাই এবে কর্‌ ভোগ!-পড়ে হাহাকার
নিমেষে সে সুখ-স্বর্গে, নিবে যায় বাতি,
কাটিতে চাহে না যেন আর কাল-রাতি!
চল-পথে অনশন-ক্লিষ্ট ক্ষীণ তনু,
কী দেখি’ বাঁকিয়া ওঠে সহসা ভ্রূ-ধনু,
দু’নয়ন ভরি’ রুদ্র হানো অগ্নি-বাণ,
আসে রাজ্যে মহামারী দুর্ভিক্ষ তুফান,
প্রমোদ-কানন পুড়ে, উড়ে অট্টালিকা,-
তোমার আইনে শুধু মৃত্যু-দন্ড লিখা!

বিনয়ের ব্যভিচার নাহি তব পাশ,
তুমি চান নগ্নতার উলঙ্গ প্রকাশ।
সঙ্কোচ শরম বলি’ জান না ক’ কিছু,
উন্নত করিছ শির যার মাথা নীচু।
মৃত্যু-পথ-যাত্রীদল তোমার ইঙ্গিতে
গলায় পরিছে ফাঁসি হাসিতে হাসিতে!
নিত্য অভাবের কুন্ড জ্বালাইয়া বুকে
সাধিতেছ মৃত্যু-যজ্ঞ পৈশাচিক সুখে!
লক্ষ্মীর কিরীটি ধরি, ফেলিতেছ টানি’
ধূলিতলে। বীণা-তারে করাঘাত হানি’
সারদার, কী সুর বাজাতে চাহ গুণী?
যত সুর আর্তনাদ হ’য়ে ওঠে শুনি!
প্রভাতে উঠিয়া কালি শুনিনু, সানাই
বাজিছে করুণ সুরে! যেন আসে নাই
আজো কা’রা ঘরে ফিরে! কাঁদিয়া কাঁদিয়া
ডাকিছে তাদেরে যেন ঘরে ‘সানাইয়া’!
বধূদের প্রাণ আজ সানা’য়ের সুরে
ভেসে যায় যথা আজ প্রিয়তম দূরে
আসি আসি করিতেছে! সখী বলে, ‘বল্‌
মুছিলি কেন লা আঁখি, মুছিলি কাজল?….

শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই
‘ আয় আয়’ কাঁদিতেছে তেমনি সানাই।
ম্লানমুখী শেফালিকা পড়িতেছে ঝরি’
বিধবার হাসি সম-স্নিগ্ধ গন্ধে ভরি’!
নেচে ফেরে প্রজাপতি চঞ্চল পাখায়
দুরন্ত নেশায় আজি, পুষ্প-প্রগল্‌ভায়
চুম্বনে বিবশ করি’! ভোমোরার পাখা
পরাগে হলুদ আজি, অঙ্গে মধু মাখা।

উছলি’ উঠিছে যেন দিকে দিকে প্রাণ!
আপনার অগোচরে গেয়ে উঠি গান
আগমনী আনন্দের! অকারণে আঁখি
পু’রে আসে অশ্রু-জলে! মিলনের রাখী
কে যেন বাঁধিয়া দেয় ধরণীর সাথে!
পুষ্পঞ্জলি ভরি’ দু’টি মাটি মাখা হাতে
ধরণী এগিয়ে আসে, দেয় উপহার।
ও যেন কনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী আমার!-
সহসা চমকি’ উঠি! হায় মোর শিশু
জাগিয়া কাঁদিছ ঘরে, খাওনি ক’ কিছু
কালি হ’তে সারাদিন তাপস নিষ্ঠুর,
কাঁদ’ মোর ঘরে নিত্য তুমি ক্ষুধাতুর!

পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার,
দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে!-মোর অধিকার
আনন্দের নাহি নাহি! দারিদ্র্য অসহ
পুত্র হ’য়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ
আমার দুয়ার ধরি! কে বাজাবে বাঁশি?
কোথা পাব আনন্দিত সুন্দরের হাসি?
কোথা পাব পুষ্পাসব?-ধুতুরা-গেলাস
ভরিয়া করেছি পান নয়ন-নির্যাস!….
আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই,
ও যেন কাঁদিছে শুধু-নাই কিছু নাই!
কবিতার বিষয়: জীবনমুখী কবিতা, বিরহের কবিতা
___________________________________________________________

নারী

                                     সাম্যের গান গাই -
আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?
তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।
অথবা পাপ যে - শয়তান যে - নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
তাজমহলের পাথর দেখেছে, দেখিয়াছ তার প্রাণ?
অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।
জ্ঞানের লক্ষ্ণী, গানের লক্ষ্ণী, শস্য-লক্ষ্ণী নারী,
সুষমা-লক্ষ্ণী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি’।
পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,
কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ।
দিবসে দিয়াছে শক্তি-সাহস, নিশীথে হয়েছে বধু,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে, নারী যোগায়েছে মধু।
শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল, পুরুষ চালাল হল,
নারী সে মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে’
ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালি ধানের শীষে।

                                     স্বর্ণ-রৌপ্যভার
নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হয়েছে অলঙ্কার।
নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।
নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে’
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে।
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নী ও বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন্ রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি’ কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্ণী নারী।
রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রানী,
রানির দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।

                                     পুরুষ হৃদয়হীন,
মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ।
ধরায় যাঁদের যশ ধরে না ক’ অমর মহামানব,
বরষে বরষে যাঁদের স্মরণে করি মোরা উৎসব।
খেয়ালের বশে তাঁদের জন্ম দিয়াছে বিলাসী পিতা।
লব-কুশে বনে তাজিয়াছে রাম, পালন করেছে সীতা।
নারী সে শিখাল শিশু-পুরুষেরে স্নেহ প্রেম দয়া মায়া,
দীপ্ত নয়নে পরাল কাজল বেদনার ঘন ছায়া।
অদ্ভূতরূপে পুরুষ পুরুষ করিল সে ঋণ শোধ,
বুকে করে তারে চুমিল যে, তারে করিল সে অবরোধ।

                                     তিনি নর-অবতার -
পিতার আদেশে জননীরে যিনি কাটেন হানি’ কুঠার।
পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর -
নারী চাপা ছিল এতদিন, আজ চাপা পড়িয়াছে নর।

                                     সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি’।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে!

                                     যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই।

                                     শোনো মর্ত্যের জীব!
অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লীব!
স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরীতে নারী
করিল তোমায় বন্দিনী, বল, কোন্‌ সে অত্যাচারী?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা,
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!
চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায় মল,
মাথার ঘোম্‌টা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও-শিকল!
যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ,
দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন ঐ যত আভরণ!

                                     ধরার দুলালী মেয়ে,
ফির না তো আর গিরিদরীবনে পাখী-সনে গান গেয়ে।
কখন আসিল ‘প্নুটো’ যমরাজা নিশীথ-পাখায় উড়ে,
ধরিয়া তোমায় পুরিল তাহার আঁধার বিবর-পুরে!
সেই সে আদিম বন্ধন তব, সেই হতে আছ মরি’
মরণের পুরে; নামিল ধরায় সেইদিন বিভাবরী।
ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মতো আয় মা পাতাল ফুঁড়ি!
আঁধারে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি!
পুরুষ-যমের ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও পদাঘাতে
লুটায়ে পড়িবে ও চরণ-তলে দলিত যমের সাথে!
এতদনি শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে,
যে-হাতে পিয়ালে অমৃত, সে-হাতে কূট বিষ দিতে হবে।

                                     সেদিন সুদূর নয়-
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!

___________________________________________________________

পিছু-ডাক

সখি! নতুন ঘরে গিয়ে আমায় প’ড়বে কি আর মনে?
সেথা তোমার নতুন পূজা নতুন আয়োজনে!
প্রথম দেখা তোমায় আমায়
যে গৃহ-ছায় যে আঙিনায়,
যেথায় প্রতি ধূলিকণায়,
লতাপাতার সনে
নিত্য চেনার বিত্ত রাজে চিত্ত-আরাধনে,
শূন্য সে ঘর শূন্য এখন কাঁদছে নিরজনে।।

সেথা তুমি যখন ভুল্‌তে আমায়, আস্‌ত অনেক কেহ,
তখন আমার হ’য়ে অভিমানে কাঁদত যে ঐ গেহ।
যেদিক পানে চাইতে সেথা
বাজ্‌তে আমার স্মৃতির ব্যথা,
সে গ্লানি আজ ভুলবে হেথা
নতুন আলাপনে।
আমিই শুধু হারিয়ে গেলেম হারিয়ে-যাওয়ার বনে।।

আমার এত দিনের দূর ছিল না সত্যিকারের দুর,
ওগো আমার সুদুর ক’রত নিকট ঐ পুরাতন পুর।
এখন তোমার নতুন বাঁধন
নতুন হাসি, নতুন কাঁদন,
নতুন সাধন, গানের মাতন
নতুন আবাহনে।
আমারই সুর হারিয়ে গেল সুদুর পুরাতন।।

সখি! আমার আশাই দুরাশা আজ, তোমার বিধির বর,
আজ মোর সমাধির বুকে তোমার উঠবে বাসর-ঘর!
শূণ্য ভ’রে শুনতে পেনু
ধেনু-চরা বনের বেণু-
হারিয়ে গেনু হারিয়ে গেনু
অন–দিগঙ্গনে।
বিদায় সখি, খেলা-শেষ এই বেলা-শেষের খনে!
এখন তুমি নতুন মানুষ নতুন গৃহকোণে।।
কবিতার বিষয়: বিরহের কবিতা
__________________________________________________________

পূজারিণী

এত দিনে অবেলায়-
প্রিয়তম!
ধূলি-অন্ধ ঘূর্ণি সম
দিবাযামী
যবে আমি
নেচে ফিরি র”ধিরাক্ত মরণ-খেলায়-
এ দিনে অ-বেলায়
জানিলাম, আমি তোমা’ জন্মে জন্মে চিনি।
পূজারিণী!
ঐ কন্ঠ, ও-কপোত- কাঁদানো রাগিণী,
ঐ আখি, ঐ মুখ,
ঐ ভুর”, ললাট, চিবুক,
ঐ তব অপরূপ রূপ,
ঐ তব দোলো-দোলো গতি-নৃত্য দুষ্ট দুল রাজহংসী জিনি’-
চিনি সব চিনি।

তাই আমি এতদিনে
জীবনের আশাহত ক্লান- শুষ্ক বিদগ্ধ পুলিনে
মূর্ছাতুর সারা প্রাণ ভ’রে
ডাকি শুকু ডাকি তোমা’
প্রিয়তমা!
ইষ্ট মম জপ-মালা ঐ তব সব চেয়ে মিষ্ট নাম ধ’রে!
তারি সাথে কাঁদি আমি-
ছিন্ন-কন্ঠে কাঁদি আমি, চিনি তোমা’, চিনি চিনি চিনি,
বিজয়িনী নহ তুমি-নহ ভিখারিনী,
তুমি দেবী চির-শুদ্ধ তাপস-কুমারী, তুমি মম চির-পূজারিণী!
যুগে যুগে এ পাষাণে বাসিয়াছ ভালো,
আপনারে দাহ করি, মোর বুকে জ্বালায়েছ আলো,
বারে বারে করিয়াছ তব পূজা-ঋণী।
চিনি প্রিয়া চিনি তোমা’ জন্মে জন্মে চিনি চিনি চিনি!
চিনি তোমা’ বারে বারে জীবনের অস–ঘাটে, মরণ-বেলায়,
তারপর চেনা-শেষে
তুমি-হারা পরদেশে
ফেলে যাও একা শুণ্য বিদায়-ভেলায়!

দিনানে-র প্রানে- বসি’ আঁখি-নীরে তিনি’
আপনার মনে আনি তারি দূর-দূরানে-র স্মৃতি-
মনে পড়ে-বসনে-র শেষ-আশা-ম্লান মৌন মোর আগমনী সেই নিশি,
যেদিন আমার আঁখি ধন্য হ’ল তব আখি-চাওয়া সনে মিশি।
তখনো সরল সুখী আমি- ফোটেনি যৌবন মম,
উন্মুখ বেদনা-মুখী আসি আমি ঊষা-সম
আধ-ঘুমে আধ-জেগে তখনো কৈশোর,
জীবনের ফোটো-ফোটো রাঙা নিশি-ভোর,
বাধা বন্ধ-হারা
অহেতুক নেচে-চলা ঘূর্ণিবায়ু-পারা
দুরন- গানের বেগ অফুরন- হাসি
নিয়ে এনু পথ-ভোলা আমি অতি দূর পরবাসী।
সাথে তারি
এনেছিনু গৃহ-হারা বেদনার আঁখি-ভরা বারি।
এসে রাতে-ভোরে জেগে গেয়েছিনু জাগরণী সুর-
ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছিলে তুমি কাছে এসেছিলে,
মুখ-পানে চেয়ে মোর সকর”ণ হাসি হেসেছিলে,-
হাসি হেরে কেঁদেছিনু-‘তুমি কার পোষাপাখী কান-ার বিধুর?’
চোখে তব সে কী চাওয়া! মনে হ’ল যেন
তুমি মোর ঐ কন্ঠ ঐ সুর-
বিরহের কান্না-ভারাতুর
বনানী-দুলানো,
দখিনা সমীরে ডাকা কুসুম-ফোটানো বন-হরিণী-ভুলানো
আদি জন্মদিন হ’তে চেন তুমি চেন!
তারপর-অনাদরে বিদায়ের অভিমান-রাঙা
অশ্র”-ভাঙা-ভাঙা
ব্যথা-গীত গেয়েছিনু সেই আধ-রাতে,
বুঝি নাই আমি সেই গান-গাওয়া ছলে
কারে পেতে চেয়েছিনু চিরশূন্য মম হিয়া-তলে-
শুধু জানি, কাঁচা-ঘুমে জাগা তব রাগ-অর”ণ-আঁখি-ছায়া
লেগেছিল মম আঁখি-পাতে।
আরো দেখেছিনু, ঐ আঁখির পলকে
বিস্ময়-পুলক-দীপ্তি ঝলকে ঝলকে
ঝ’লেছিল, গ’লেছিল গাঢ় ঘন বেদানার মায়া,-
কর”ণায় কেঁপে কেঁপে উঠেছিল বিরহিণী
অন্ধকার-নিশীথিনী-কায়া।

তৃষাতুর চোখে মোর বড় যেন লেগেছিল ভালো
পূজারিণী! আঁখি-দীপ-জ্বালা তব সেই সিগ্ধ সকর”ণ আলো।

তারপর-গান গাওয়া শেষে
নাম ধ’রে কাছে বুঝি ডেকেছিনু হেসে।
অমনি কী গ’র্জে-উঠা র”দ্ধ অভিমানে
(কেন কে সে জানে)
দুলি’ উঠেছিল তব ভুর”-বাঁধা সি’র আঁখি-তরী,
ফুলে উঠেছিল জল, ব্যথা-উৎস-মুখে তাহা ঝরঝর
প’ড়েছিল ঝরি’!
একটু আদরে এত অভিমানে ফুলে-ওঠা, এত আঁখি-জল,
কোথা পেলি ওরে কা’র অনাদৃতা ওরে মোর ভিখারিনী
বল্‌ মোরে বল্‌ ।
এই ভাঙা বুকে
ঐ কান্না-রাঙা মুখ থুয়ে লাজ-সুখে
বল্‌ মোরে বল্‌-
মোরে হেরি’ কেন এত অভিমান?
মোর ডাকে কেন এত উথলায় চোখে তব জল?
অ-চেনা অ-জানা আমি পথের পথিক
মোরে হেরে জলে পুরে ওঠে কেন এত ঐ বালিকার আঁখি অনিমিখ?
মোর পানে চেয়ে সবে হাসে,
বাঁধা-নীড় পুড়ে যায় অভিশপ্ত তপ্ত মোর শ্বাসে;
মণি ভেবে কত জনে তুলে পরে গলে,
মণি যবে ফণী হয়ে বিষ-দগ্ধ-মুখে
দংশে তার বুকে,
অমনি সে দলে পদতলে!
বিশ্ব যারে করে ভয় ঘৃণা অবহেলা,
ভিখরিণী! তারে নিয়ে এ কি তব অকর”ণ খেলা?
তারে নিয়ে এ কি গূঢ় অভিমান? কোন্‌ অধিকারে
নাম ধ’রে ডাকটুকু তা’ও হানে বেদনা তোমারে?
কেউ ভালোবাসে নাই? কেই তোমা’ করেনি আদর?
জন্ম-ভিখারিনী তুমি? তাই এত চোখে জল, অভিমানী কর”ণা-কাতর!
নহে তা’ও নহে-
বুকে থেকে রিক্ত-কন্ঠে কোন্‌ রিক্ত অভিমানী কহে-
‘নহে তা’ও নহে।’
দেখিয়াছি শতজন আসে এই ঘরে,
কতজন না চাহিতে এসে বুকে করে,
তবু তব চোখে-মুখে এ অতৃপ্তি, এ কী স্নেহ-ক্ষুধা
মোরে হেলে উছলায় কেন তব বুক-ছাপা এত প্রীতি সুধা?
সে রহস্য রাণী!
কেহ নাহি জানে-
তুমি নাহি জান-
আমি নাহি জানি।
চেনে তা প্রেম, জানে শুধু প্রাণ-
কোথা হ’তে আসে এত অকারণে প্রাণে প্রাণে বেদনার টান!

নাহি বুঝিয়াও আমি সেদিন বুঝিনু তাই, হে অপরিচিতা!
চির-পরিচিতা তুমি, জন্ম জন্ম ধ’রে অনাদৃতা সীতা!
কানন-কাঁদানো তুমি তাপস-বালিকা
অনন- কুমারী সতী, তব দেব-পূজার থালিকা
ভাঙিয়াছি যুগে যুগে, ছিঁড়িয়াছি মালা
খেলা-ছলে; চিন-মৌনা শাপভ্রষ্টা ওগো দেববালা!
নীরবে স’য়েছ সবি-
সহজিয়া! সহজে জেনেছ তুমি, তুমি মোর জয়লক্ষ্মী, আমি তব কবি।
তারপর-নিশি শেষে পাশে ব’সে শুনেছিনু তব গীত-সুর
লাজে-আধ-বাধ-বাধ শঙ্কিত বিধুর;
সুর শুনে হ’ল মনে- ক্ষণে ক্ষণে
মনে-পড়ে-পড়ে না হারা কন্ঠ যেন
কেঁদে কেঁদে সাধে, ‘ওগো চেন মোরে জন্মে জন্মে চেন।’
মথুরায় গিয়ে শ্যাম, রাধিকার ভুলেছিল যবে,
মনে লাগে- এই সুর গীত-রবে কেঁদেছিল রাধা,
অবহেলা-বেঁধা-বুক নিয়ে এ যেন রে অতি-অন-রালে ললিতার কাঁদা
বন-মাঝে একাকিনী দময়ন-ী ঘুরে ঘুরে ঝুরে,
ফেলে-যাওয়া নাথে তার ডেকেছিল ক্লান–কন্ঠে এই গীত-সুরে।
কানে- প’ড়ে মনে
বনলতা সনে
বিষাদিনী শকুন-লা কেঁদেছিল এই সুরে বনে সঙ্গোপনে।
হেম-গিরি-শিরে
হারা-সতী উমা হ’য়ে ফিরে
ডেকেছিল ভোলানাথে এমনি সে চেনা কন্ঠে হায়,
কেঁদেছিল চির-সতী পতি প্রিয়া প্রিয়ে তার পেতে পুনরায়!-
চিনিলাম বুঝিলাম সবি-
যৌবন সে জাগিল না, লাগিল না মর্মে তাই গাঢ় হ’য়ে তব মুখ-ছবি।

তবু তব চেনা কন্ঠ মম কন্ঠ -সুর
রেখে আমি চ’লে গেনু কবে কোন্‌ পল্লী-পথে দূরে!–
দু’দিন না যেতে যেতে এ কি সেই পুণ্য গোমতীর কূলে
প্রথম উঠিল কাঁদি’ অপরূপ ব্যথা-গন্ধ নাভি-পদ্ম-মুলে!

খুঁজে ফিরি কোথা হ’তে এই ব্যাথা-ভারাতুর মদ-গন্ধ আসে-
আকাশ বাতাস ধরা কেঁপে কেঁপে ওঠে শুধু মোর তপ্ত ঘন দীর্ঘশ্বাসে।
কেঁদে ওঠে লতা-পাতা,
ফুল পাখি নদীজল
মেঘ বায়ু কাঁদে সবি অবিরল,
কাঁদে বুকে উগ্রসুখে যৌবন-জ্বালায়-জাগা অতৃপ্ত বিধাতা!
পোড়া প্রাণ জানিল না কারে চাই,
চীৎকারিয়া ফেরে তাই-‘কোথা যাই,
কোথা গেলে ভালোবাসাবাসি পাই?
হু-হু ক’রে ওঠে প্রাণ, মন করে উদাস-উদাস,
মনে হয়-এ নিখিল যৌবন-আতুর কোনো প্রেমিকের ব্যথিত হুতাশ!
চোখ পুরে’ লাল নীল কত রাঙা, আবছায়া ভাসে, আসে-আসে-
কার বক্ষ টুটে
মম প্রাণ-পুটে
কোথা হ’তে কেন এই মৃগ-মদ-গন্ধ-ব্যথা আসে?
মন-মৃগ ছুটে ফেরে; দিগন-র দুলি’ ওঠে মোর ক্ষিপ্ত হাহাকার-ত্রাসে!
কস’রী হরিণ-সম
আমারি নাভির গন্ধ খুঁজে ফেলে গন্ধ-অন্ধ মন-মৃগ মম!
আপনারই ভালোবাসা
আপনি পিইয়া চাহে মিটাইতে আপনার আশা!
অনন- অগস-্য-তৃষাকুল বিশ্ব-মাগা যৌবন আমার
এক সিন্ধু শুষি’ বিন্দু-সম, মাগে সিন্ধু আর!
ভগবান! ভগবান! এ কি তৃষ্ণা অনন- অপার!
কোথা তৃপ্তি? তৃপ্তি কোথা? কোথা মোর তৃষ্ণা-হরা প্রেম-সিন্ধু
অনাদি পাথার!
মোর চেয়ে স্বে”ছাচারী দুরন- দুর্বার!
কোথা গেলে তারে পাই,
যার লাগি’ এত বড় বিশ্বে মোর নাই শানি- নাই!
ভাবি আর চলি শুধু, শুধু পথ চলি,
পথে কত পথ-বালা যায়,
তারি পাছে হায় অন্ধ-বেগে ধায়
ভালোবাসা-ক্ষুধাতুর মন,
পিছু ফিরে কেহ যদি চায়, ‘ভিক্ষা লহ’ ব’লে কেহ আসে দ্বার-পাশে।
প্রাণ আরো কেঁদে ওঠে তাতে,
গুমরিয়া ওঠে কাঙালের লজ্জাহীন গুর” বেদনাতে!
প্রলয়-পয়োধি-নীরে গর্জে-ওঠা হুহুঙ্কার-সম
বেদনা ও অভিমানে ফুলে’ ফুলে’ দুলে’ ওঠে ধূ-ধূ
ক্ষোভ-ক্ষিপ্ত প্রাণ-শিখা মম!
পথ-বালা আসে ভিক্ষা-হাতে,
লাথি মেরে চুর্ণ করি গর্ব তার ভিক্ষা-পাত্র সাথে।
কেঁদে তারা ফিরে যায়, ভয়ে কেহ নাহি আসে কাছে;
‘অনাথপিন্ডদ’-সম
মহাভিক্ষু প্রাণ মম
প্রেম-বুদ্ধ লাগি’ হায় দ্বারে দ্বারে মহাভিক্ষা যাচে,
“ভিক্ষা দাও, পুরবাসি!
বুদ্ধ লাগি’ ভিক্ষা মাগি, দ্বার হ’তে প্রভু ফিরে যায় উপবাসী!’’
কত এল কত গেল ফিরে,-
কেহ ভয়ে কেহ-বা বিস্ময়ে!
ভাঙা-বুকে কেহ,
কেহ অশ্র”-নীরে-
কত এল কত গেল ফিরে!
আমি যাচি পূর্ণ সমর্পণ,
বুঝিতে পারে না তাহা গৃহ-সুখী পুরনারীগণ।
তারা আসে হেসে;
শেষে হাসি-শেষে
কেঁদে তারা ফিরে যায়
আপনার গৃহ স্নেহ”ছায়ে।
বলে তারা, “হে পথিক! বল বল তব প্রাণ কোন্‌ ধন মাগে?
সুরে তব এত কান্না, বুকে তব কা’র লাগি এত ক্ষুধা জাগে?
কি যে চাই বুঝে না ক’ কেহ,
কেহ আনে প্রাণ মম কেহ- বা যৌবন ধন,
কেহ রূপ দেহ।
গর্বিতা ধনিকা আসে মদমত্তা আপনার ধনে
আমারে বাঁধিতে চাহে রূপ-ফাঁদে যৌবনের বনে।….
সর্ব ব্যর্থ, ফিরে চলে নিরাশায় প্রাণ
পথে পথে গেয়ে গেয়ে গান-
“কোথা মোর ভিখারিনী পূজারিণী কই?
যে বলিবে-‘ভালোবেসে সন্ন্যাসিনী আমি
ওগো মোর স্বামি!
রিক্তা আমি, আমি তব গরবিনী,বিজয়িনী নই!”
মর” মাঝে ছুটে ফিরি বৃথা,
হু হু ক’রে জ্ব’লে ওঠে তৃষা-
তারি মাঝে তৃষ্ণা-দগ্ধ প্রাণ
ক্ষণেকের তরে কবে হারাইল দিশা।
দূরে কার দেখা গেল হাতছানি যেন-
ডেকে ডেকে সে-ও কাঁদে-
‘আমি নাথ তব ভিখারিনী,
আমি তোমা’ চিনি,
তুমি মোরে চেন।’
বুঝিনু না, ডাকিনীর ডাক এ যে,
এ যে মিথ্যা মায়া,
জল নহে, এ যে খল, এ যে ছল মরীচিকা ছাষা!
‘ভিক্ষা দাও’ ব’লে আমি এনু তার দ্বারে,
কোথা ভিখারিনী? ওগো এ যে মিথ্যা মায়াবিনী,
ঘরে ডেকে মারে।
এ যে ক্রূর নিষাদের ফাঁদ,
এ যে ছলে জিনে নিতে চাহে ভিখারীর ঝুলির প্রসাদ।
হ’ল না সে জয়ী,
আপনার জালে প’ড়ে আপনি মরিল মিথ্যাময়ী।
কাঁটা-বেঁধা রক্ত মাথা প্রাণ নিয়ে এনু তব পুরে,
জানি নাই ব্যথাহত আমার ব্যথায়
তখনো তোমার প্রাণ পুড়ে।
তবু কেন কতবার মনে যেন হ’ত,
তব স্নিগ্ধ মদিন পরশ মুছে নিতে পারে মোর
সব জ্বালা সব দগ্ধ ক্ষত।
মনে হ’ত প্রাণে তব প্রাণে যেন কাঁদে অহরহ-
‘হে পথিক! ঐ কাঁটা মোরে দাও, কোথা তব ব্যথা বাজে
কহ মোরে কহ!
নীরব গোপন তুমি মৌন তাপসিনী,
তাই তব চির-মৌন ভাষা
শুনিয়াও শুনি নাই, বুঝিয়াও বুঝি নাই ঐ ক্ষুদ্র চাপা-বুকে
কাঁদে কত ভালোবাসা আশা!
এরি মাঝে কোথা হ’তে ভেসে এল মুক্তধারা মা আমার
সে ঝড়ের রাতে,
কোলে তুলে নিল মোরে, শত শত চুমা দিল সিক্ত আঁখি-পাতে।
কোথা গেল পথ-
কোথা গেল রথ-
ডুবে গেল সব শোক-জ্বালা,
জননীর ভালোবাসা এ ভাঙা দেউলে যেন দুলাইল দেয়ালীর আলা!
গত কথা গত জন্ম হেন
হারা-মায়ে পেয়ে আমি ভুলে গেনু যেন।
গৃহহারা গৃহ পেনু, অতি শান- সুখে
কত জন্ম পরে আমি প্রাণ ভ’রে ঘুমাইনু মুখ থুয়ে জননীর বুকে।
শেষ হ’ল পথ-গান গাওয়া,
ডেকে ডেকে ফিরে গেল হা-হা স্বরে পথসাথী তুফানের হাওয়া।
আবার আবার বুঝি ভুলিলাম পথ-
বুঝি কোন্‌ বিজয়িনী-দ্বার প্রানে- আসি’ বাধা পেল পার্থ-পথ-রথ।
ভুলে গেনু কারে মোর পথে পথ খোঁজা,-
ভুলে গেনু প্রাণ মোর নিত্যকাল ধ’রে অভিসারী
মাগে কোন্‌ পূজা,
ভুলে গেনু যত ব্যথা শোক,-
নব সুখ-অশ্র”ধারে গ’লে গেল হিয়া, ভিজে গেল অশ্র”হীন চোখ।
যেন কোন্‌ রূপ-কমলেতে মোর ডুবে গেল আঁখি,
সুরভিতে মেতে উঠে বুক,
উলসিয়া বিলসিয়া উথলিল প্রাণে
এ কী ব্যগ্র উগ্র ব্যথা-সুখ।
বাঁচিয়া নূতন ক’রে মরিল আবার
সীধু-লোভী বাণ-বেঁধা পাখী।….
…. ভেসে গেল রক্তে মোর মন্দিরের বেদী-
জাগিল না পাষাণ-প্রতিমা,
অপমানে দাবানল-সম তেজে
র”খিয়া উঠিল এইবার যত মোর ব্যথা-অর”নিমা।
হুঙ্কারিয়া ছুটিলাম বিদ্রোহের রক্ত-অশ্বে চড়ি’
বেদনার আদি-হেতু স্রষ্টা পানে মেঘ অভ্রভেদী,
ধূমধ্বজ প্রলয়ের ধূমকেতু-ধুমে
হিংসা হোমশিখা জ্বালি’ সৃজিলাম বিভীষিকা স্নেহ-মরা শুষ্ক মর”ভূমে।
…. এ কি মায়া! তার মাঝে মাঝে
মনে হ’ত কতদূরে হ’তে, প্রিয় মোর নাম ধ’রে যেন তব বীণা বাজে!
সে সুদূর গোপন পথের পানে চেয়ে
হিংসা-রক্ত-আঁখি মোর অশ্র”রাঙা বেদনার রসে যেত ছেয়ে।
সেই সুর সেই ডাক স্মরি’ স্মরি’
ভুলিলাম অতীতের জ্বালা,
বুঝিলাম তুমি সত্য-তুমি আছে,
অনাদৃতা তুমি মোর, তুমি মোরে মনে প্রাণে যাচ’,
একা তুমি বনবালা
মোর তরে গাঁথিতেছ মালা
আপনার মনে
লাজে সঙ্গোপনে।
জন্ম জন্ম ধ’রে চাওয়া তুমি মোর সেই ভিখারিনী।
অন-রের অগ্নি-সিন্ধু ফুল হ’য়ে হেসে উঠে কহে- ‘চিনি, চিনি।
বেঁচে ওঠ্‌ মরা প্রাণ! ডাকে তোরে দূর হ’তে সেই-
যার তরে এত বড় বিশ্বে তোর সুখ-শানি- নেই!’
তারি মাঝে
কাহার ক্রন্দন-ধ্বনি বাজে?
কে যেন রে পিছু ডেকে চীৎকারিয়া কয়-
‘বন্ধু এ যে অবেলায়! হতভাগ্য, এ যে অসময়!
শুনিনু না মানা, মানিনু না বাধা,
প্রাণে শুধু ভেসে আসে জন্মন-র হ’তে যেন বিরহিণী ললিতার কাঁদা!
ছুটে এনু তব পাশে
উর্ধ্বশ্বাসে,
মৃত্যু-পথ অগ্নি-রথ কোথা প’ড়ে কাঁদে, রক্ত-কেতু গেল উড়ে পুড়ে,
তোমার গোপান পূজা বিশ্বের আরাম নিয়া এলো বুক জুড়ে।

তারপর যা বলিব হারায়েছি আজ তার ভাষা;
আজ মোর প্রাণ নাই, অশ্র” নাই, নাই শক্তি আশা।
যা বলিব আজ ইহা গান নহে, ইহা শুধু রক্ত-ঝরা প্রাণ-রাঙা
অশ্র”-ভাঙা ভাষা।
ভাবিতেছ, লজ্জাহীন ভিখারীর প্রাণ-
সে-ও চাহে দেওয়ার সম্মান!
সত্য প্রিয়া, সত্য ইহা, আমিও তা স্মরি’
আজ শুধু হেসে হেসে মরি!
তবু শুধু এইটুকু জেনে রাখো প্রিয়তমা, দ্বার হ’তে দ্বারান-রে
ব্যর্থ হ’য়ে ফিরে
এসেছিনু তব পাশে, জীবনের শেষ চাওয়া চেয়েছিনু তোমা’,
প্রাণের সকল আশা সব প্রেম ভালোবাসা দিয়া
তোমারে পূজিয়াছিনু, ওগো মোর বে-দরদী পূজারিণী প্রিয়া!
ভেবেছিনু, বিশ্ব যারে পারে নাই তুমি নেবে তার ভার হেসে,
বিশ্ব-বিদ্রোহীরে তুমি করিবে শাসন
অবহেলে শুধু ভালোবাসে।
ভেবেছিনু, দুর্বিনীত দুর্জয়ীরে জয়ের গরবে
তব প্রাণে উদ্ভাসিবে অপরূপ জ্যোতি, তারপর একদিন
তুমি মোর এ বাহুতে মহাশক্তি সঞ্চারিয়া
বিদ্রোহীর জয়লক্ষ্মী হবে।
ছিল আশা, ছিল শক্তি, বিশ্বটারে টেনে
ছিঁড়ে তব রাঙা পদতলে ছিন্ন রাঙা পদ্মসম পূজা দেব এনে!
কিন’ হায়! কোথা সেই তুমি? কোথা সেই প্রাণ?
কোথা সেই নাড়ী-ছেঁড়া প্রাণে প্রাণে টান?
এ-তুমি আজ সে-তুমি তো নহ;
আজ হেরি-তুমিও ছলনাময়ী,
তুমিও হইতে চাও মিথ্যা দিয়া জয়ী!
কিছু মোরে দিতে চাও, অন্য তরে রাখ কিছু বাকী,-
দুর্ভাগিনী! দেখে হেসে মরি! কারে তুমি দিতে চাও ফাঁকি?
মোর বুকে জাগিছেন অহরহ সত্য ভগবান,
তাঁর দৃষ্টি বড় তীক্ষ্ন, এ দৃষ্টি যাহারে দেখে,
তন্ন তন্ন ক’রে খুঁজে দেখে তার প্রাণ!
লোভে আজ তব পূজা কলুষিত, প্রিয়া,
আজ তারে ভুলাইতে চাহ,
যারে তুমি পূজেছিলে পূর্ণ মন-প্রাণ সমর্পিয়া।
তাই আজি ভাবি, কার দোষে-
অকলঙ্ক তব হৃদি-পুরে
জ্বলিল এ মরণের আলো কবে প’শে?
তবু ভাবি, এ কি সত্য? তুমিও ছলনাময়ী?
যদি তাই হয়, তবে মায়াবিনী অয়ি!
ওরে দুষ্ট, তাই সত্য হোক।
জ্বালো তবে ভালো ক’রে জ্বালো মিথ্যালোক।
আমি তুমি সুর্য চন্দ্র গ্রহ তারা
সব মিথ্যা হোক;
জ্বালো ওরে মিথ্যাময়ী, জ্বালো তবে ভালো ক’রে
জ্বালো মিথ্যালোক।
তব মুখপানে চেয়ে আজ
বাজ-সম বাজে মর্মে লাজ;
তব অনাদর অবহেলা স্মরি’ স্মরি’
তারি সাথে স্মরি’ মোর নির্লজ্জতা
আমি আজ প্রাণে প্রাণে মরি।
মনে হয়-ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি, ‘মা বসুধা দ্বিধা হও!
ঘৃণাহত মাটিমাখা ছেলেরে তোমার
এ নির্লজ্জ মুখ-দেখা আলো হ’তে অন্ধকারে টেনে লও!
তবু বারে বারে আসি আশা-পথ বাহি’,
কিন’ হায়, যখনই ও-মুখ পানে চাহি-
মনে হয়,-হায়,হায়, কোথা সেই পূজারিণী,
কোথা সেই রিক্ত সন্ন্যাসিনী?
এ যে সেই চির-পরিচিত অবহেলা,
এ যে সেই চির-ভাবহীন মুখ!
পূর্ণা নয়, এ যে সেই প্রাণ নিয়ে ফাঁকি-
অপমানে ফেটে যায় বুক!
প্রাণ নিয়া এ কি নিদার”ণ খেলা খেলে এরা হায়!
রক্ত-ঝরা রাঙা বুক দ’লে অলক্তক পরে এরা পায়!
এর দেবী, এরা লোভী, এরা চাহে সর্বজন-প্রীতি!
ইহাদের তরে নহে প্রেমিকের পূর্ণ পূজা, পূজারীর পূর্ণ সমর্পণ,
পূজা হেরি’ ইহাদের ভীর” বুকে তাই জাগে এত সত্য-ভীতি।
নারী নাহি হ’তে চায় শুধু একা কারো,
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো!
ইহাদের অতিলোভী মন
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়,
যাচে বহু জন।..
যে-পূজা পূজিনি আমি স্রষ্টা ভগবানে,
যারে দিনু সেই পূজা সে-ই আজি প্রতারণা হানে।
বুঝিয়াছি, শেষবার ঘিরে আসে সাথী মোর মৃত্যু-ঘন আঁখি,
রিক্ত প্রাণ তিক্ত সুখে হুঙ্কারিয়া উঠে তাই,
কার তরে ওরে মন, আর কেন পথে পথে কাঁদি?
জ্বলে’ ওঠ্‌ এইবার মহাকাল ভৈরবের নেত্রজ্বালা সম ধ্বক্‌-ধ্বক্‌,
হাহাকার-করতালি বাজা! জ্বালা তোর বিদ্রোহের রক্তশিখা অনন- পাবক।
আন্‌ তোর বহ্নি-রথ, বাজা তোর সর্বনাশী তূরী!
হান্‌ তোর পরশু-ত্রিশুল! ধ্বংস কর্‌ এই মিথ্যাপুরী।
রক্ত-সুধা-বিষ আন্‌ মরণের ধর টিপে টুটি!
এ মিথ্যা জগৎ তোর অভিশপ্ত জগদ্দল চাপে হোক্‌ কুটি-কুটি!
কন্ঠে আজ এত বিষ, এত জ্বালা,
তবু, বালা,
থেকে থেকে মনে পড়ে-
যতদিন বাসিনি তোমারে ভালো,
যতদিন দেখিনি তোমার বুক-ঢাকা রাগ-রাঙা আলো,
তুমি ততদিনই
যেচেছিলে প্রেম মোর, ততদিনই ছিলে ভিখারিনী।
ততদিনই এতটুকু অনাদরে বিদ্রোহের তিক্ত অভিমানে
তব চোখে উছলাতো জল, ব্যথা দিত তব কাঁচা প্রাণে;
একটু আদর-কণা একটুকু সোহাগের লাগি’
কত নিশি-দিন তুমি মনে কর, মোর পাশে রহিয়াছ জাগি’,
আমি চেয়ে দেখি নাই; তারই প্রতিশোধ
নিলে বুঝি এতদিনে! মিথ্যা দিয়ে মোরে জিনে
অপমান ফাঁকি দিয়ে করিতেছ মোর শ্বাস-রোধ!
আজ আমি মরণের বুক থেকে কাঁদি-
অকর”ণা! প্রাণ নিয়ে এ কি মিথ্যা অকর”ণ খেলা!
এত ভালোবেসে শেষে এত অবহেলা
কেমনে হানিতে পার, নারী!
এ আঘাত পুর”ষের,
হানিতে এ নির্মম আঘাত, জানিতাম মোরা শুধু পুর”ষেরা পারি।
ভাবিতাম, দাগহীন অকলঙ্ক কুমারীর দান,
একটি নিমেষ মাঝে চিরতরে আপনারে রিক্ত করি’ দিয়া
মন-প্রাণ লভে অবসান।
ভুল, তাহা ভুল
বায়ু শুধু ফোটায় কলিকা, অলি এসে হ’রে নেয় ফুল!
বায়ু বলী, তার তরে প্রেম নহে প্রিয়া!
অলি শুধু জানে ভালো কেমনে দলিতে হয় ফুল-কলি-হিয়া!
পথিক-দখিনা-বায়ু আমি চলিলাম বসনে-র শেষে
মৃত্যুহীন চিররাত্রি নাহি-জানা দেশে!
বিদায়ের বেলা মোর ক্ষণে ক্ষণে ওঠে বুকে আনন্দাশ্র” ভরি’
কত সুখী আমি আজ সেই কথা স্মরি’!
আমি না বাসিতে ভালো তুমি আগে বেসেছিলে ভালো,
কুমারী-বুকের তব সব স্নিগ্ধ রাগ-রাঙা আলো
প্রথম পড়িয়াছিল মোর বুকে-মুখে-
ভুখারীর ভাঙা বুকে পুলকের রাঙা বান ডেকে যায় আজ সেই সুখে!
সেই প্রীতি, সেই রাঙা সুখ-স্মৃতি স্মরি’
মনে হয় এ জীবন এ জনম ধন্য হ’ল- আমি আজ তৃপ্ত হ’য়ে মরি!
না-চাহিতে বেসেছিলে ভালো মোরে তুমি-শুধু তুমি,
সেই সুখে মৃত্যু-কৃষ্ণ অধর ভরিয়া
আজ আমি শতবার ক’রে তব প্রিয় নাম চুমি’।
মোরে মনে প’ড়ে-
একদা নিশীথে যদি প্রিয়
ঘুশায়ে কাহারও বুকে অকারণে বুক ব্যথা করে,
মনে ক’রো, মরিয়াছে, গিয়াছে আপদ!
আর কভু আসিবে না
উগ্র সুখে কেহ তব চুমিতে ও-পদ-কোকনদ!
মরিয়াছে-অশান- অতৃপ্ত চির-স্বার্থপর লোভী,-
অমর হইয়া আছে-র’বে চিরদিন
তব প্রেমে মৃত্যুঞ্জয়ী
ব্যথা-বিষে নীলকণ্ঠ কবি!
কবিতার বিষয়: প্রেমের কবিতা, বিবিধ কবিতা
___________________________________________________________

বারাঙ্গনা

   কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও-গায়ে?
   হয়ত তোমায় স-ন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।
   না-ই হ’লে সতী, তবু তো তোমরা মাতা-ভগিনীরই জাতি;
   তোমাদের ছেলে আমাদেরই মতো, তারা আমাদের জ্ঞাতি;
   আমাদেরই মতো খ্যাতি যশ মান তারাও লভিতে পারে,
   তাহাদের সাধনা হানা দিতে পারে সদর স্বর্গ-দ্বারে।-
   স্বর্গবেশ্যা ঘৃতাচী-পুত্র হ’ল মহাবীর দ্রোণ,
   কুমারীর ছেলে বিশ্ব-পূজ্য কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন.
   কানীন-পুত্র কর্ণ হইল দান-বীর মহারথী
   স্বর্গ হইতে পতিতা গঙ্গা শিবেরে পেলেন পতি,
   শান-নু রাজা নিবেদিল প্রেম পুনঃ সেই গঙ্গায়-
   তাঁদেরি পুত্র অমর ভীষ্ম, কৃষ্ণ প্রণমে যায়!
   মুনি হ’ল শুনি সত্যকাম সে জারজ জবালা-শিশু,
   বিস্ময়কর জন্ম যাঁহার-মহাপ্রেমিক সে যিশু!-
   কেহ নহে হেথা পাপ-পঙ্কিল, কেহ সে ঘৃণ্য নহে,
   ফুটিছে অযুত বিমল কমল কামনা-কালীয়-দহে!
      শোনো মানুষের বাণী,
   জন্মের পর মানব জাতির থাকে না ক’ কোনো গ্লানি!
   পাপ করিয়াছি বলিয়া কি নাই পুণ্যেরও অধিকার?
   শত পাপ করি’ হয়নি ক্ষুন্ন দেবত্ব দেবতার।
   অহল্যা যদি মুক্তি লভে, মা, মেরী হ’তে পারে দেবী,
   তোমরাও কেন হবে না পূজ্যা বিমল সত্য সেবি’?
   তব সন্তানে জারজ বলিয়া কোন্‌ গোঁড়া পাড়ে গালি,
   তাহাদের আমি এই দু’টো কথা জিজ্ঞাসা করি খালি-
      দেবতা গো জিজ্ঞাসি-
   দেড় শত কোটি সন্তান এই বিশ্বের অধিবাসী-
   কয়জন পিতা-মাতা ইহাদের হ’য়ে নিষ্কাম ব্রতী
   পুত্রকন্যা কামনা করিল? কয়জন সৎ-সতী?
   ক’জন করিল তপস্যা ভাই সন্তান-লাভ তরে?
   কার পাপে কোটি দুধের বা”চা আঁতুড়ে জন্মে’ মরে?
   সেরেফ্‌ পশুর ক্ষুধা নিয়ে হেথা মিলে নরনারী যত,
   সেই কামানার সন্তান মোরা! তবুও গর্ব কত!
       শুন ধর্মের চাঁই-
   জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো সে প্রভেদ নাই!
   অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ-পুত্র হয়,
   অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!
কবিতার বিষয়: বিবিধ কবিতা, মানবতাবাদী কবিতা
___________________________________________________________

বিদায়-বেলায়

তুমি অমন ক’রে গো বারে বারে জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না,
জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না।
ঐ কাতর কন্ঠে থেকে থেকে শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না,
শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না।।
হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা,
আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।
ঐ ব্যথাতুর আঁখি কাঁদো-কাঁদো মুখ
দেখি আর শুধু হেসে যাও,আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।
চলার তোমার বাকী পথটুকু-
পথিক! ওগো সুদূর পথের পথিক-
হায়, অমন ক’রে ও অকর”ণ গীতে আঁখির সলিলে ছেয়ো না,
ওগো আঁখির সলিলে ছেয়ো না।।

দূরের পথিক! তুমি ভাব বুঝি
তব ব্যথা কেউ বোঝে না,
তোমার ব্যথার তুমিই দরদী একাকী,
পথে ফেরে যারা পথ-হারা,
কোন গৃহবাসী তারে খোঁজে না,
বুকে ক্ষত হ’য়ে জাগে আজো সেই ব্যথা-লেখা কি?
দূর বাউলের গানে ব্যথা হানে বুঝি শুধু ধূ-ধূ মাঠে পথিকে?
এ যে মিছে অভিমান পরবাসী! দেখে ঘর-বাসীদের ক্ষতিকে!
তবে জান কি তোমার বিদায়- কথায়
কত বুক-ভাঙা গোপন ব্যথায়
আজ কতগুলি প্রাণ কাঁদিছে কোথায়-
পথিক! ওগো অভিমানী দূর পথিক!
কেহ ভালোবাসিল না ভেবে যেন আজো
মিছে ব্যথা পেয়ে যেয়ো না,
ওগো যাবে যাও, তুমি বুকে ব্যথা নিয়ে যেয়ো না।।
কবিতার বিষয়: বিরহের কবিতা
__________________________________________________________

মানুষ

          গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সল কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
          'পূজারী, দুয়ার খোল,
ক্ষুদার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো!'
স্বপ্ন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়
দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ'য়ে যাবে নিশ্চয়!
জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুদায় কন্ঠ ক্ষীণ
ডাকিল পান্থ, 'দ্বার খোল বাবা, খাইনি তো সাত দিন!'
সহসা বন্ধ হ'ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে,
তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুদার মানিক জ্বলে!
          ভুখারী ফুকারি' কয়,
'ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!'

মসজিদে কাল শিরনী আছিল, অঢেল গোস্ত রুটি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটিকুটি!
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে-আজারির চিন্
বলে 'বাবা, আমি ভুকা ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন!'
তেরিয়াঁ হইয়া হাঁকিল মোল্লা - "ভ্যালা হ'ল দেখি লেঠা,
ভুখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?"
ভুখারী কহিল, 'না বাবা!' মোল্লা হাঁকিল - তা' হলে শালা
সোজা পথ দেখ!' গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা!
          ভুখারী ফিরিয়া চলে,
          চলিতে চলিতে বলে-
"আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুদার অন্ন তা'বলে বন্ধ করোনি প্রভু
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!"

_________________________________________________________

মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যম

মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যম
মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল,
মোরা বিধাতার মত নির্ভয়
মোরা প্রকৃতির মত স্বচ্ছল।।
মোরা আকাশের মত বাঁধাহীন
মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন,
বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন
চিত্তমুক্ত শতদল।।
মোরা সিন্ধু জোঁয়ার কলকল
মোরা পাগলা জোঁয়ার ঝরঝর।
কল-কল-কল, ছল-ছল-ছল
মোরা দিল খোলা খোলা প্রান্তর,
মোরা শক্তি অটল মহীধর।
হাসি গান শ্যাম উচ্ছল
বৃষ্টির জল বনফল খাই-
শয্যা শ্যামল বনতল।।
__________________________________________________________

মোহররম

নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া,-
‘আম্মা! লা’ল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া!’
কাঁদে কোন্ ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে!
রুদ্র মাতম্ ওঠে দুনিয়া-দামেশ্ কে-
‘জয়নালে পরালো এ খুনিয়ারা বেশ কে?’
‘হায় হায় হোসেনা’,  ওঠে রোল ঝঞ্ঝায়,
তল্ ওয়ার কেঁপে ওঠে এজিদেরো পঞ্জায়!
উন্ মাদ ‘দুল্ দুল্’ ছুটে ফেরে মদিনায়,
আদি-জাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায়!
মা ফতেমা আস্ মানে কাঁদে খুলি কেশপাশ,
বেটাদের লাশ নিয়ে বধূদের শ্বেতবাস!
রণে যায় কাসিম ঐ দু’ঘড়ির নওশা,
মেহেদীর রঙটুকু মুছে গেল সহসা!
‘হায় হায়’ কাঁদে বায় পূরবী ও দখিনা--
‘কঙ্কণ পঁইচি খুলে ফেল সকীনা!’
কাঁদে কে রে কোলে ক’রে কাসিমের কাটা-শির?
খান্ খান্ হয়ে ক্ষরে বুক-ফাটা নীর!
কেঁদে গেছে থামি’ হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,
বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র!
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,
‘আম্মা গো পানি দাও ফেটে গেল ছাতি মা!’
নিয়ে তৃষা সাহারার, দুনিয়ার হাহাকার,
কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার!
দুই হাত কাটা তবু শের-নর আব্বাস,
পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশ্ মনও ‘সাব্বাস্’!
দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা,
হাঁকে বীর ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা!’
কলিজা কাবাব সম ভুনে মরু-রোদ্দুর,
খাঁ-খাঁ করে কারবালা, নাই পানি খর্জ্জুর,
মা’র স্তনে দুধ নাই, বাচ্চারা তড়্ পায়!
জিভ চুষে’ কচি জান থাকে কিরে ধড়্ টায়?
দাউ দাউ জ্বলে শিরে কারবালা-ভাস্কর,
কাঁদে বানু-- ’পানি দাও, মরে যাদু আস্ গর!’
পেলো না তো পানি শিশু পিয়ে গেল কাঁচা খুন,
ডাকে মাতা, পানি দেবো ফিরে আয় বাছা শুন্!
পুত্রহীনার আর বিধবার কাঁদনে
ছিঁড়ে আনে মর্ম্মের বত্রিশ বাঁধনে!
তাম্বুতে শয্যায় কাঁদে একা জয়নাল,
‘দাদা ! তেরি ঘর্ কিয়া বরবাদ্ পয়মাল!’
‘হাইদরী-হাঁক-হাঁকি দুলদুল-আসওয়ার
শম্ শের চম্ কায় দুষমনে ত্রাস্ বার।
খ’সে পড়ে হাত হ’তে শত্রুর তরবার,
ভাসে চোখে কিয়ামতে আল্লার দরবার!
নিঃশেষ দুষমন্; ও কে রণ-শ্রান্ত
ফোরাতের নীরে নেমে মুছে আঁখি-প্রান্ত?
কোথা বাবা আস্ গর? শোকে বুক-ঝাঁঝরা
পানি দেখে হোসেনের ফেটে যায় পাঁজরা!
ধুঁকে ম’লো আহা তবু পানি এক কাৎরা
দেয় নি রে বাছাদের মুখে কম্ জাত্ রা!
অঞ্জলি হ’তে পানি প’ড়ে গেল ঝর্-ঝর্,
লুটে ভূমে মহাবাহু খঞ্জর-জর্জ্জর!
হল্ কুমে হানে তেগ ও কে ব’সে ছাতিতে?--
আফ্ তাব ছেয়ে নিল আঁধিয়ারা রাতিতে।
‘আস্ মান’ ভ’রে গেল গোধূলিতে দুপুরে,
লাল নীল খুন ঝরে কুফরের উপরে!
বেটাদের লোহু-রাঙা পিরাহান-হাতে, আহ্--
‘আরশের’ পায়া ধরে, কাঁদে মাতা ফাতেমা,
‘এয়্ খোদা বদ্ লাতে বেটাদের রক্তের
মার্জ্জনা কর গোনা পাপী কম্ বখতের।’
কত মোহর্ রম এলো, গেল চ’লে বহু কাল--
ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল!
মুস্ লিম ! তোরা আজ ‘জয়নাল আবেদীন্’,
‘ওয়া হোসেনা-- ওয়া হোসেনা’ কেঁদে তাই যাবে দিন!
ফিরে এলো আজ সেই মোহর্ রম মাহিনা,--
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না!
উষ্ণীষ কোরানের, হাতে তেগ্ আরবীর,
দুনিয়াতে নত নয় মুস্ লিম কারো শির,--
তবে শোন ঐ বাজে কোথা দামামা,
শম্ শের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা!
বেজেছে নাকাড়া, হাঁকে নকীবের তুর্য্য,
হুঁশিয়ার ইসলাম, ডুবে তব সূর্য্য!
জাগো ওঠ মুস্ লিম, হাঁকো হাইদরী হাঁক।
শহীদের দিনে সব লালে-লাল হ’য়ে যাক্!
নওশার সাজ নাও খুন-খচা আস্তীন,
ময়দানে লুটাতে রে লাশ এই খাস্ দিন!
হাসানের মতো পি’ব পিয়ালা সে জহরের,
হোসেনের মতো নিব বুকে ছুরি কহরের;
আস্ গর সম দিব বাচ্চারে কোর্ বান,
জালিমের দাদ নেবো, দেবো আজ গোর জান!
সকীনার শ্বেতবাস দেবো মাতা কন্যায়,
কাসিমের মত দেবো জান রুধি’ অন্যায়!
মোহর্ রম্! কারবালা! কাঁদো ‘হায় হোসেনা!’
দেখো মরু-সূর্য্যে এ খুন যেন শোষে না!


উৎস: অগ্নিবীণা
__________________________________________________________

মুনাজাত

আমারে সকল ক্ষুদ্রতা হতে
          বাঁচাও প্রভু উদার।
হে প্রভু! শেখাও - নীচতার চেয়ে
          নীচ পাপ নাহি আর।

যদি শতেক জন্ম পাপে হই পাপী,
     যুগ-যুগান্ত নরকেও যাপি,
     জানি জানি প্রভু, তারও আছে ক্ষমা-
               ক্ষমা নাহি নীচতার।।

ক্ষুদ্র করো না হে প্রভু আমার
          হৃদয়ের পরিসর,
যেন সম ঠাঁই পায়
          শত্রু-মিত্র-পর।

নিন্দা না করি ঈর্ষায় কারো
     অন্যের সুখে সুখ পাই আরো,
     কাঁদি তারি তরে অশেষ দুঃখী
               ক্ষুদ্র আত্মা তার।।
__________________________________________________________

লিচু চোর



বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাড়া।

পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,

ও বাবা মড়াত করে
পড়েছি সরাত জোরে।
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুষি
একদম জোরসে ঠুসি।

আমিও বাগিয়ে থাপড়
দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়
লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল,
দেখি এক ভিটরে শেয়াল!

সেকি ভাই যায় রে ভুলা-
মালীর ঐ পিটুনিগুলা!
কি বলিস ফের হপ্তা!
তৌবা-নাক খপ্তা!
কবিতার বিষয়: ছোটদের ছড়া-কবিতা

1 comment:

  1. Casino Night - MapyRO
    Casino Night is located in 공주 출장안마 the 목포 출장안마 middle of town 하남 출장안마 in 화성 출장안마 Lake 영주 출장안마 Charles, Iowa, with its location and activities under the direction of the DOWNTOWN DOWNTOWN DOWNTOWN DOWNTOWN DOWNTOWN DOWNTOWN DOWNTOWN DOWNTOWN

    ReplyDelete