Wednesday, March 20, 2013

সুকুমার রায়


আবোল তাবোল


আয়রে ভোলা খেয়াল‐খোলা
    স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
    মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়। 

আয় যেখানে ক্ষ্যাপার গানে
    নাইকো মানে নাইকো সুর,
আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়
    মন ভেসে যায় কোন সুদূর।...

আয় ক্ষ্যাপা‐মন ঘুচিয়ে বাঁধন
    জাগিয়ে নাচন তাধিন্ ধিন্,
আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া
    নিয়মহারা হিসাবহীন।
আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল
    মাতবি মাতাল রঙ্গেতে—
আয়রে তবে ভুলের ভবে
    অসম্ভবের ছন্দেতে॥

______________________________________________________________________________


কাঠ বুড়ো

                  - সুকুমার রায়

হাঁড়ি নিয়ে দাড়িমুখো কে–যেন কে বৃদ্ধ
রোদে বসে চেটে খায় ভিজে কাঠ সিদ্ধ ।
মাথা নেড়ে গান করে গুন্ গুন্ সঙ্গীত
ভাব দেখে মনে হয় না–জানি কি পণ্ডিত !
বিড়্ বিড়্ কি যে বকে নাহি তার অর্থ—
"আকাশেতে ঝুল ঝোলে, কাঠে তাই গর্ত ।"
টেকো মাথা তেতে ওঠে গায়ে ছোটে ঘর্ম,
রেগে বলে, "কেবা বোঝে এ সবের মর্ম ?
আরে মোলো, গাধাগুলো একেবারে অন্ধ,
বোঝেনাকো কোনো কিছু খালি করে দ্বন্দ্ব ।
কোন্ কাঠে কত রস জানে নাকো তত্ত্ব,
একাদশী রাতে কেন কাঠে হয় গর্ত ?"

আশে পাশে হিজি বিজি আঁকে কত অঙ্ক
ফাটা কাঠ ফুটো কাঠ হিসাব অসংখ্য ;
কোন্ ফুটো খেতে ভালো, কোন্‌টা বা মন্দ,
কোন্ কোন্ ফাটলের কি রকম গন্ধ ।
কাঠে কাঠে ঠুকে করে ঠকাঠক শব্দ ।
বলে, "জানি কোন্ কাঠ কিসে হয় জব্দ ;
কাঠকুঠো ঘেঁটেঘুঁটে জানি আমি পষ্ট,
এ কাঠের বজ্জাতি কিসে হয় নষ্ট ।
কোন্ কাঠ পোষ মানে, কোন কাঠ শান্ত,
কোন্ কাঠ টিম্‌টিমে, কোন্‌টা বা জ্যান্ত ।
কোন্ কাঠে জ্ঞান নেই মিথ্যা কি সত্য,
আমি জানি কোন্ কাঠে কেন থাকে গর্ত ।"
কবিতার বিষয়: ছোটদের ছড়া-কবিতা
_______________________________________________

হুলোর গান


বিদ্‌ঘুটে রাত্তিরে ঘুট্‌ঘুটে ফাঁকা,
           গাছপালা মিশ্‌মিশে মখ‌্‌মলে ঢাকা!
জট্‌বাঁধা ঝুল কালো বটগাছতলে,
           ধক্‌ধক্ জোনাকির চক্‌মকি জ্বলে।
চুপচাপ চারিদিকে ঝোপ ঝাড়গুলো,
           আয় ভাই গান গাই আয় ভাই হুলো।
গীত গাই কানে কানে চীৎকার ক'রে,
           কোন্ গানে মন ভেজে শোন্ বলি তোরে।
পূবদিকে মাঝরাতে ছোপ্ দিয়ে রাঙা
           রাতকানা চাঁদ ওঠে আধখানা ভাঙা।
চট্ ক'রে মনে পড়ে মট্‌কার কাছে
           মালপোয়া আধখানা কাল থেকে আছে।
দুড়্ দুড়্ ছুটে যাই, দূর থেকে দেখি
           প্রাণপণে ঠোঁট চাটে কানকাটা নেকী!
গালফোলা মুখে তার মালপোয়া ঠাসা,
           ধুক ক'রে নিভে গেল বুকভরা আশা।
মন বলে আর কেন সংসারে থাকি,
           বিল্‌কুল্ সব দেখি ভেল্‌কির ফাঁকি।
সব যেন বিচ্ছিরি সব যেন খালি,
           গিন্নীর মুখ যেন চিম্‌নির কালি।
মন–ভাঙা দুখ্ মোর কন্ঠেতে পুরে
           গান গাই আয় ভাই প্রাণফাটা সুরে।
কবিতার বিষয়: ছোটদের ছড়া-কবিতা
_________________________________________________________

হাত গণনা


ও পাড়ার নন্দগোঁসাই, আমাদের নন্দ খুড়ো,
স্বভাবেতে সরল সোজা অমায়িক শান্ত বুড়ো৷
ছিল না তাঁর অসুখবিসুখ, ছিল সে যে মনের সুখে,
দেখা যেত সদাই তারে হুঁকো হাতে হাস্যমুখে৷
হঠাৎ কি তার খেয়াল হল, চল্‌ল সে তার হাত দেখাতে
ফিরে এল শুকনো সরু, ঠকাঠক্‌ কাঁপছে দাঁতে!
শুধালে সে কয় না কথা, আকাশেতে রয় সে চেয়ে,
মাঝে মাঝে শিউরে ওঠে, পড়ে জল চক্ষু বেয়ে৷
শুনে লোকে দৌড়ে এল, ছুটে এলেন বদ্যিমশাই,
সবাই বলে, 'কাঁদছ কেন ? কি হয়েছে নন্দগোঁসাই?'
  
খুড়ো বলে, 'বলব কি আর, হাতে আমার পষ্ট লেখা
আমার ঘাড়ে আছেন শনি, ফাঁড়ায় ভরা আয়ুর রেখা৷
এতদিন যায়নি জানা ফিরছি কত গ্রহের ফেরে—
হঠাৎ আমার প্রাণটা গেলে তখন আমায় রাখবে কে রে?
ষাটটা বছর পার হয়েছি বাপদাদাদের পুণ্যফলে—
ওরা তোদের নন্দ খুড়ো এবার বুঝি পটোল তোলে৷
কবে যে কি ঘটবে বিপদ কিছু হায় যায় না বলা—'
এই ব'লে সে উঠল কেঁদে ছেড়ে ভীষণ উচ্চ গলা৷
দেখে এলাম আজ সকালে গিয়ে ওদের পাড়ার মুখো,
বুড়ো আছে নেই কো হাসি, হাতে তার নেই কো হুঁকো৷
কবিতার বিষয়: ছোটদের ছড়া-কবিতা
_______________________________________________________


কাতুকুতু বুড়ো

আর যেখানে যাও না রে ভাই সপ্তসাগর পার,
কাতুকুতু বুড়োর কাছে যেও না খবরদার!
সর্বনেশে বৃদ্ধ সে ভাই যেও না তার বাড়ি—
কাতুকুতুর কুলপি খেয়ে ছিঁড়বে পেটের নাড়ি।
কোথায় বাড়ি কেউ জানে না, কোন্‌ সড়কের মোড়ে,
একলা পেলে জোর ক’রে ভাই গল্প শোনায় প’ড়ে।
বিদ্‌ঘুটে তার গল্পগুলো না জানি কোন দেশী,
শুনলে পরে হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি।
না আছে তার মুণ্ডু মাথা না আছে তার মানে,
তবুও তোমায় হাসতে হবে তাকিয়ে বুড়োর পানে।
কেবল যদি গল্প বলে তাও থাকা যায় সয়ে,
গায়ের উপর সুড়সুড়ি দেয় লম্বা পালক লয়ে।
কেবল বলে, “হোঃ হোঃ হোঃ, কেষ্টদাসের পিসি—
বেচ্‌ত খালি কুমড়ো কচু হাঁসের ডিম আর তিসি।
ডিমগুলো সব লম্বা মতন, কুমড়োগুলো বাঁকা,
কচুর গায়ে রঙ‐বেরঙের আল্‌পনা সব আঁকা।
অষ্ট প্রহর গাইত পিসি আওয়াজ করে মিহি,
ম্যাও ম্যাও ম্যাও বাকুম বাকুম ভৌ ভৌ ভৌ চীঁহি।”
এই না বলে কুটুত্‍‌ ক’রে চিম্‌টি কাটে ঘাড়ে,
খ্যাংরা মতন আঙুল দিয়ে খোঁচায় পাঁজর হাড়ে।
তোমায় দিয়ে সুড়সুড়ি সে আপনি লুটোপুটি,
যতক্ষণ না হাসবে তোমার কিচ্ছুতে নাই ছুটি।
_________________________________________________________
কাঁদুনে
ছিচ্‌কাঁদুনে মিচকে যারা সস্তা কেঁদে নাম কেনে,
ঘ্যাঁঙায় শুধু ঘ্যানর ঘ্যানর ঘ্যান্‌ঘ্যানে আর প্যানপ্যানে—
কুঁকিয়ে কাঁদে খিদের সময়, ফুঁপিয়ে কাঁদে ধম্‌কালে,
কিম্বা হঠাৎ লাগলে ব্যাথা, কিম্বা ভয়ে চম্‌কালে;
অল্পে হাসে অল্পে কাঁদে, কান্না থামায় অল্পেতেই;
মায়ের আদর দুধের বোতল কিম্বা দিদির গল্পেতেই—
তারেই বলি মিথ্যে কাঁদন, আসল কান্না শুনবে কে?
অবাক্ হবে থম্‌কে রবে সেই কাঁদনের গুণ দেখে!
নন্দঘোষের পাশের বাড়ী বুথ্ সাহেবের বাচ্চাটার
কান্নাখানা শুনলে বলি কান্না বটে সাচ্চা তার।
কাঁদবে না সে যখন তখন, রাখবে কেবল রাগ পুষে,
কাঁদবে যখন খেয়াল হবে খুন–কাদুনে রাক্ষুসে!
নাইকো কারণ নাইকো বিচার মাঝরাতে কি ভোরবেলা,
হঠাৎ শুনি অর্থবিহীন আকাশ–ফাটান জোর গলা।
হাঁকড়ে ছোটে কান্না যেমন জোয়ার বেগে নদীর বান,
বাপ মা বসেন হতাশ হয়ে শব্দ শুনে বধির কান।
বাসরে সে কি লোহার গলা? এক মিনিটও শান্তি নেই?
কাঁদন ঝরে শ্রাবণ ধারে, ক্ষান্ত দেবার নামটি নেই!
ঝুমঝুমি দাও পুতুল নাচাও, মিষ্টি খাওয়াও একশোবার,
বাতাস কর, চাপড়ে ধর, ফুটবে নাকো হাস্য তার।
কান্নাভরে উল্‌টে পড়ে কান্না ঝরে নাক দিয়ে,
গিলতে চাহে দালানবাড়ী হাঁ'খানি তার হাঁক্ দিয়ে,
ভূত–ভাগানো শব্দে লোকে ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ে—
কান্না শুনে ধন্যি বলি বুথ্ সাহেবের বাচ্চারে।

No comments:

Post a Comment